Welcome To Sundarban TV ||সুন্দরবন টিভিতে আপনাকে স্বাগত || সুন্দরবন টিভি সুন্দরবনের মানুষের জীবন কথা

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী হাল চাষ

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী হাল চাষ



 নিহাররঞ্জন মন্ডল ও উমাশঙ্কর মন্ডল

৬০-৮০ দশকে পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি বছর বৈশাখ মাসে সুনির্দিষ্ট দিনে দক্ষিণবঙ্গে আমন ধানের চাষ শুরু হত। ঐ দিন সকালে চাষি লাঙ্গল, জোয়াল, আংড়াদড়া আর একজোড়া বলদকে নমস্কার করে শঙ্খ উলুধ্বনি সহযোগে লাঙ্গল প্রস্তুত করে দুটো "আঁতরে" ৭ বা ৯ পাক লাঙ্গল চালিয়ে ঐ দিনের মতো চাষ সমাপ্ত করত। এটাকে বলা হত "হালপন্নে" করা।
এর পর বৃষ্টির জল অনুসারে জমি ভাঙা (প্রথম চাষ) হত, অন্যদিকে স্বল্প জলযুক্ত জমিতে চাতর(বীজতলা) তৈরির কাজ চলত। বাড়িতে বীজধানকে হাল্কা মাটিযুক্ত ডুবন্ত ঘোলা জলে রাত্রে বাঁশের চটার ডোলে ভিজিয়ে পরদিন সকালে জল ঝরিয়ে চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে ছায়াতে ২ দিন রাখা হত (এটাকে ধান জাঁক দেওয়া বলা হত)। ২ দিন পর সন্ধ্যাবেলা আবার বের করে ৫ মিনিট ডুবন্ত জলে ভিজিয়ে আবার ২ দিন রাখা হত, আবার ২ দিন পর সন্ধ্যাবেলা বের করে  জড়ানো কলা'র ( অঙ্কুর) জট ছাড়িয়ে ৫ মিনিট ডুবন্ত জলে  ভিজিয়ে আবার রেখে দেওয়া হত। ২ দিন পর সকালে বের করে জড়ানো কলা'র(অঙ্কুর) জট খোলা হত। উক্ত ৫/৬ দিনের মধ্যে চাতরে বার বার চাষ ও বাসুঁই(নরম কাদা মাটিকে সমান করার জন্য লম্বা মোটা কাঠের তক্তা) দিয়ে ন্যাপালী (নরম ক্ষীরের মতো) কাদা করে কলা করা ধান একমুঠো চাতরের এক কোণে ছড়ানো হতো, তারপরে চাতরের বাকি অংশে সমস্ত কলা ধান ছড়িয়ে দেওয়া হত। চাতরে দ্বিতীয় দিন আধ ইঞ্চি তৃতীয় দিন ১ ইঞ্চি এভাবে জল বাড়ানো হত। ২৫/২৬ দিনে পাতা (ধানের চারা) অন্য জায়গায় রোয়ার উপযোগী হয়ে যেত।

এর মধ্যে ভাল দিন দেখে চাষি একদিন সকালে খাওয়ার আগে স্নান করে ১টা কলমীশাকের চারা, ১টা পাটের চারা, ১টা কালো কচুর চারা আর অল্প ধানের চারা শঙ্খ উলুধ্বনির সহযোগে ৯ টা গোছ পুঁতে  দিত, এটাকে বলত "গুছুড়ি"। অন্য দিকে জমিতে দ্বিতীয় চাষ তারপর তৃতীয় চাষ ও বাসুঁই তারপর আবার চতুর্থ চাষ ও বাসুঁই দিয়ে পাতার আটি (ধানের চারার বান্ডিল) নিয়ে দূরে দূরে অন্যান্য জমিতে রোয়া হত। ধানের চারাকে উপড়ে বান্ডিল বাঁধাকে বলা হত "পাতাছাবা"। পাতার বান্ডিলকে একে অপরের সাথে জুড়ে জুড়ে আধ বা এক কিমি. লম্বা করে জলের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হত অন্য জমিতে, দেখতে লম্বা কেন্নো বা সাপের মতো একে বলা হত পাতার "হালী"। হালিকে টেনে টেনে নিয়ে যাওয়ার একটা আনন্দই আলাদা ছিলো।

চাষের শেষ দিনে প্রত্যেক চাষির বাড়িতে তৈরি হতো সিদ্ধ চাল ভেজে ঢেঁকিতে গুড়ো করে খেজুরের গুড় সহযোগে  "হালো গোদার ভুদো" (মোয়া)।  প্রথমে হালের গরুর মাথায়, শিংএ, পায়ে, ক্ষুরে ও গায়ে সর্ষের তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে ভুদো খাওয়ানো হত, তার পরে  চাষি  বা অন্যান্যদের ভুদো খাওয়ানো ও বিলি করা হত। জোতদারদের বাড়িতে মাইনের লোকদের দুপুরে মানকচু বা ওল সহযোগে রুইমাছ, গাঢ় মটর ডাল ও খেজুরের গুড় ভোজন করানো হত। ভোজন শেষে মাইনের লোকদের পান, নতুন গামছা দিয়ে বিদায় জানাত।
কার্তিক মাসের শেষে ধান আধ পাকা হলে শুভ দিনে সন্ধ্যাবেলা ৯ টা গোছ একসাথে বেঁধে সিঁদুর লাগিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে একটা বাঁশের মাথায় পাটকাঠি বেঁধে আগুন লাগিয়ে গান গাওয়া হত " মা লক্ষী গো ঘরে বসো গো, একপালি ধান দাও, একপালি টাকা দাও গো "(লক্ষীর বিয়ে দেওয়া) এটা মুসলমানরা ও মানত, তারা বলত "লোকের বিলি(মাঠে)  হুড়ো নাড়া(শুধু মোটাখড়), আংগো বিলি কুলো ঝাড়া"( ভাল ধান হোক। অগ্রহায়ণ মাসের শেষে ভালো দিন দেখে চাষি সকালে স্নান করে কাস্তে হাতে এক ঘটি জল নিয়ে মাঠে গিয়ে  ৯টা ধানের শীষ একসাথে সামান্য জল দিয়ে  শঙ্খ উলুধ্বনির সহযোগে কেটে - ধান,ঘটি আর কাস্তে মাথায় করে বাড়িতে এনে নিকনো উঠোনের কোনে রেখে দিত, এটাকে বলা হত "হালাকাটা", সন্ধ্যায় ঘরে এনে পুজো করার জায়গায় রেখে দিত, চৈত্র মাসে লক্ষীপুজার সময় ঐ ধান লক্ষীর "আড়ি"(বংশানুক্রমিক মা লক্ষীর পূজার জন্য কাঁসা বা পিতলের বিশেষ বাটি) বাটিতে দেওয়া হত।

অনেক গরীব চাষির উপযুক্ত চাষের বলদ থাকলে জোতদারদের বাড়িতে চাষের কাজে  ৩ মাসের জন্য ৫/৬ বস্তা ধানের চুক্তিতে দেওয়া হত, এটাকে বলা হত গরু "পুর" দেওয়া অর্থাত্  মানুষের মতো গরুকে লেবার খাটানো।

অল্প জলযুক্ত জমিতে পাটনাই(লম্বা মোটা চাল , রুপশাল(সরু লম্বা চাল), লীলাবতী (সুগন্ধি  সরু চাল), তালমুগুর(কালচে মোটা চাল) ধান চাষ হত। এই সমস্ত ধানগাছ ৪/৫ ফুট লম্বা হত। বিঘা প্রতি ১৫/১৬ মণ ধান হত। অধিক জলযুক্ত জমিতে কুমড়োবোড়(হলদে খোসাযুক্ত ভিতরে মোটা সাদা চাল, হোগলা(কালো খোসাযুক্ত ভিতরে লালচে মোটা চাল), গেড়ি(লালচে ধারীযুক্ত খোসা, ভিতরে সাদা মোটা চাল, মুড়ির ভাজার উপযুক্ত চাল, "ফুটের" ধান বলা হত) খেজুরছড়ি(মোটা  সাদা চাল, মুড়ি ভাজার উপযুক্ত চাল), দুধেমোটা(ফুটকি ফুটকি কালোযুক্ত খোসা,ভিতরে মোটা চাল) ইত্যাদি ধান হত। এই সমস্ত ধানগাছ ৭/৮ ফুট লম্বা হত,  বিঘা প্রতি ১২/১৫ মণ ধান হত। এই ধানগাছ বেশি লম্বা হওয়ায় নিচের অংশ নাড়া (মোটা খড়) দিয়ে ঘরের ছাওনি ও উপরের অংশ গরুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হত।

ধান কাটার ও অনেক কায়দা ছিল। মাটিতে গোড়া সমেত আধা খড় বাদ রেখে কেটে নেওয়া কে বলা হত "দাওয়া", গোড়া সমেত কেটে ফেলে রাখাকে বলা হত "গোড়া দেওয়া", গোড়া দিয়ে ফেলে রাখা শুকনো ধান গাছকে মাঝামাঝি জায়গা থেকে কেটে নেওয়াকে বলা হত "মাথালী দেওয়া"। কেটে নেওয়া শিষের বান্ডিলকে বলা হত "বিড়ে"। বিড়েকে হাতের বিশেষ কায়দায় ঘুরিয়ে বাঁধা হত।

বিড়ে বাড়িতে নিয়ে গোল করে উঁচু ঢিপি দেওয়াকে বলা হত ধানের "গাদি"। পৌষ সংক্রান্তির দিন সন্ধাবেলা গাদির চার পাশে ঘুরিয়ে গোবরের সিঙ্গল লেপন ও কুলের পাতায় একটু গোবর ও একটা ধান গাদার গায়ে দেওয়াকে বলা হত "বামনী দেওয়া"।

 ফাল্গুন চৈত্র মাসে উঠোনের মাঝে মোটা ৪/৫ ইন্চি ব্যাসের ৮/৯ ফিট  লম্বা  কাঠের ২/৩ ফুট মাটিতে পোঁতা হত, তাকে বলা হত "মিংএ"এবং  মিংএ - র গায়ে একদিন আগে সিন্দুর গোড়ায় প্রদীপ দেওয়া হত, মিংএ - র গায় গোল মোটা দড়ি  লাগিয়ে বাকি ১৮/২০ ফিট লম্বা  দড়ির গায়ে ২/৩ ফুট দূরে দূরে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা  একটা দড়ি বাঁধা হত, একে বলা হত "দ্যামন"। দ্যামনের প্রত্যেক ছোট দড়িতে একটা করে বলদ গরু বেঁধে  মুখে ঠুঁসি(বাঁশের বা দড়ির মাস্ক লাগিয়ে দেওয়া হত, যাতে ধান না খেতে পারে) লাগিয়ে ধানের গাদা ভেঁঙে বিড়ে খুলে গরুর পায়ের নিচে দিয়ে গরুদের ঘোরানো  হত যাতে গরুর পায়ের চাপে ধান ঝরে গিয়ে খড়ের নিচে জমা হয়, ধান ঝাড়ার এই পদ্ধতিকে বলা হত "মলন দেওয়া"।  মাঝে মাঝে খড়কে নেড়ে দেওয়াকে বলা হত "তলাসার" দেওয়া। পরে ধান আর খড় আলাদা করে তেজ হাওয়াতে ধান কুলোয় করে উঁচু থেকে ছেড়ে ধুলো ও অপুষ্ট ধান আলাদা করা হত, একে বলা হত ধান "উড়ানো"। আর অপুষ্ট ধানকে বলা হত ঘুষো। এর পর ধান থেকে চাল তৈরির কাজ শুরু হত।

কালের বিবর্তনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসারের ফলে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গরুর হাল। একসময় দেখা যেত সকালে ঘুম থেকে উঠে কৃষকরা কাঁধে লাঙল জোয়াল নিয়ে জমি চাষের জন্য মাঠে যেত।  সেই দৃশ্যগুলো এখন শুধুই ঐতিহ্য।এখনা আর সেই দিন নেই, সেই দিন গুলি এখন শুধুই কল্পনায়। গ্রাম বাংলা থেকে গরুর হাল বিলুপ্তির প্রধান কারন হলো আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার। 


এক সময় ছিলো যখন গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ও গোয়াল ভরা গরু এসবই গ্রাম বাংলার কৃষকদের প্রাচীন ঐতিহ্য হলেও বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারের ফলে সেই ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে।  জনসংখ্য বৃদ্ধির ফলে দিনকে দিন কমে যাচ্ছে আবাদী জমি ও বসত ভিটা।  ফলে ভাটা পড়ছে গরু পালনে।  ইচ্ছা থাকলেও গোয়াল ঘরের জায়গার অভাবে হয়ে উঠছে না আর গরু পালন।

একসময় গরু ছাড়া কৃষিকাজ ছিল অসম্ভব যার কারনে কৃষকরা বাধ্য হয়েই গরু পালন করতো।  এখন জমির সল্পতার কারনে গরু পালন ছেড়ে দিয়েছে অনেক কৃষক।  বর্তমানে পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টরের প্রচলনে হারিয়ে যেতে বসেছে গবাদী পশু দিয়ে হালচাষ।  এক সময় যে কোন ফসল ফলানোর আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করতো।  কিন্তু এখন কৃষি ফসল ফলানোর জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হওয়ায় গরু দিয়ে হাল চাষ এখন বিলুৃপ্তির পথে ।

তবে এখনো গ্রামাঞ্চলে অল্প সংখ্যক গৃহস্থ পরিবারে চোখে পড়ে গরুর হাল।  এক সময় হালচাষ করতে অনেক কৃষক বাড়িতে গরু পালন করতো।  আবার অনেক কৃষক গরুর হাল কে পেশা হিসেবে ব্যবহার করতো এবং তা দিয়ে সংসার চালাত।  গরু দিয়ে হাল চাষে সময় লাগলেও কৃষকরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে গরুর হাল সংগ্রহ করতো।  হালের গরু দিয়ে গরীব মানুষ তাদের পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতো।  যেসব কৃষক গরু দিয়ে হালচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন কালের বিবর্তনে তারা পেশা হারিয়ে অন্য উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

এক সময় খন্ড খন্ড জমিতে হাল চাষের একমাত্র মাধ্যম ছিল গরুর হাল।  এখন ঐসব জমিতে ট্রিলার দিয়ে হালচাষ করতে অনেক বেগ পেতে হয়।  চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার হওয়ায় ধীরে ধীরে গরুর হালচাষ হারিয়ে যাচ্ছে।  তবুও অনেক কৃষক বাপ দাদার এই গরুর হাল চাষ পদ্ধত্বি টিকিয়ে রেখেছেন।  হয়তো ভবিষ্যতে প্রযুক্তির আরো ব্যবহারের ফলে গ্রাম বাংলা থেকে একেবারে হারিয়ে যাবে গরুর হাল চাষ পদ্ধত্বি।  কৃষকরা এখন কৃষিকাজে ব্যবহার করছে পাওয়ার ট্রিলার, ট্রাক্টর, ধান মাড়াই মেসিন, ধানকাটা মেসিন , ধান লাগোনো মেসিন, সার প্রয়োগের মেসিন সহ আধুনিক সব যন্ত্রপাতি।  কিছু বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে গরু দিয়ে হালচাষ, ধান মাড়াই করা হতো।  এখন সেই দৃশ্য গুিল আর চোখে পড়েনা।  এখন আর কৃষকরা ভোর বেলা পান্তাভাত খেয়ে লাঙল জোয়াল নিয়ে জমি চাষের উদ্দেশ্য বের হয় না।

এদিকে কৃষিকাজে শ্রম বেশি লাভ কম তাই অনেকে জমি ছেড়ে দিয়েছে।  এছাড়া গোখাদ্যর মূল্য বৃদ্ধি, গোচারন ভূমীর সল্পতার কারনে গরু পালন ছেড়ে দিয়েছে অনেকে।  এভাবেই নানা কারনে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গরুর হাল।

এপার বাংলা ও ওপার বাংলার ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব নবান্ন। পালিত হয় অগ্রহায়ন মাসেই। বাংলার কৃষি সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। "নবান্ন" শব্দের অর্থ "নতুন অন্ন"। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদযাপনের প্রথা রয়েছে। নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন গুড় সহ নতুন অন্ন নতুন চালের তৈরি খাবার বানিয়ে প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের, সেই সঙ্গে কাক-কে দেওয়া নবান্নের অঙ্গ একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য পূর্ব-পুরুষদের কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে "কাকবলী"। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহ দেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল।

নবান্ন উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন প্রথা। হিন্দুশাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও তার রীতি নির্দিষ্ট করে বর্ণিত করা রয়েছে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃ-পুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দু বিধি অনুযায়ে নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। একদা অত্যন্ত সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব উদযাপন হত,সকল মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিল। কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই নবান্ন উৎসব বিলুপ্তপ্রায়। তবে এখনও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু এলাকায় নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গ্রামে নবান্ন উৎসব উদযাপিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ,বীরভূম, বর্ধমান সহ বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই উৎসব আবহমানকাল ধরে উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়ে আসছে ।


এই উৎসবে নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা পায়েস, ক্ষীর-সহ নানা রকম খাবার। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। সোনালী ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির বিশেষ অংশ নবান্ন ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায় উঠে এসেছে প্রকৃতির চিত্র। এই উৎসব উপলক্ষ্যে ঘরে ঘরে তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর- পায়েসসহ নানা উপাদান। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। হাজার বছরের পুরনো এই উৎসবটি যুগ যুগ ধরে একইভাবে পালন হয়ে আসছে। নবান্ন উৎসবে গ্রামগঞ্জে আয়োজন করা হয় গ্রামীণ মেলার।
 ‘‘আকাশজুড়ে জল থৈ থৈ যুবতী চাঁদ আকাশ জোড়া। আলো গলে পড়ে মোম। চরাচরব্যাপী শূন্যতায় আমাদের সময়। তাঁর আচলের ঘ্রাণের মতো ধানের ঘ্রাণ। চোখের চতুষ্কোণে কুয়াশার রাজধানী। ওগো হেমন্তের মেয়ে আমি তোমার দ্বারে আমার ছায়ার সমান অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তোমার শরীরের নবান্ন ঘ্রাণ বড্ড নাকে লাগছে। ধূপময় গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিক। পাকা আমন ধানের কিড়া লাগে। এই নবান্নে আমাকে তুমি গ্রহণ করো। দেখ বুলবুলি ফিঙে শালিকের পালকে শীত অসারতা। তবু কুয়াশার স্বেদ আর মাটিবর্তী মেহনতি মানুষের ঘামের চৈতন্যে বুঁদ হয়ে থাকা আমি নবান্নের উৎসব নিয়ে তোমার কপালে এঁকে দেব ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের টিপ।’’

প্রকৃতি এ সময় তার অপূর্ব রূপে সেজে ওঠে ৷ আর এমন প্রাকৃতিক শোভার মধ্যে দিয়ে হেমন্তের একটি সময়ে যখন অগ্রহায়ণের দিন শুরু ৷ শীতের অসারতা ক্রমশ প্রকৃতিকে কেমন রুগ্ন করতে থাকে। কৃষকের রাশি রাশি ভাড়া ভাড়া ধান পড়ে থাকে দাওয়ায়। কিষান কিষানী কারও যেন ঘুম নেই। পথে পথে, উঠোনে, চাতালে ভরা ধান।

মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে ধানের মিশেল সে গন্ধের মাদকতায় অস্থির হতে হয়। এ গন্ধ অতিক্রম করা যায়? এই ঘ্রাণই বাঙালির অযুত বছরের সিন্দুকে রাখা ধূপের মতো । ভূমি কেন্দ্রিক সভ্যতার উৎসবই ফসল কেন্দ্রিক। হেমন্তে ধানের বৈভবে, ঘ্রাণে অস্থির জীবকূল, তাদের স্থিরতা দেয় নবান্ন। নতুন ধানের পিঠে, পায়েস। হেমন্তের এই ঐশ্বর্য মণ্ডিত উপাদান স্মরণ করিয়ে দেয় তার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ নবান্নের কথা। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার কবিতায় লিখেছেন—

মিলনোৎসবে সেও তো পড়েনি বাকি;

নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা;

পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি;

একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা’

 নবান্নের ঘ্রাণ আজন্ম লালিত অন্তর্গত গহীনের উৎসবের আমেজ নতুন স্বপ্ন ডাকে। পাড়া-পড়শী, আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে এ উৎসব যে ব্যাপ্তি নিয়ে পালিত হয় তাকে কৃষকের উৎসব শুধু নয়, কৃষিনির্ভর মেহনতি মানুষের বছরের মূল শস্য উৎপাদনের পর এ এক লোক উৎসব। বছরের মূল শস্য আহরণের এ সময় গাঙ্গেয় এ উপত্যকায় অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি কামনা এবং সন্তান ও পশুসম্পদের আকাঙ্ক্ষায় আদি যুগে এ ধরনের উৎসব চালু ছিল বলে জানা যায়। তার বাস্তব কিছু প্রমাণও পাওয়া যায় । উত্তর পশ্চিম ভারতের ওয়াজিয়াবাদে নবান্ন উৎসব পালিত হতো বৈশাখ মাসে। আর প্রচলন করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ।

নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা নবান্নের অঙ্গ, একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে এ খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায় বলে তাদের ধারণা। এই নৈবেদ্যকে বলে কাকবলী। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। এর মধ্যে অনেক অঞ্চলের লৌকিকতার বিষয়াবলীকে ধরা যায়। কোনো অঞ্চলের লৌকিকতাকে পুরো অঞ্চলের সংস্কৃতি বলে চালানোর প্রবণতাটা আমাদের সংস্কৃতি বিকাশের অন্তরায়। সর্বজনীনতার তো বটেই। প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন প্রথা ছিল। সে অঞ্চলে আর্থসামাজিক অবস্থা, ভৌগলিক পরিস্থিতির মাপকাঠিতে সেখানকার মানুষের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আজ যেমন সব অঞ্চলের সংস্কৃতির একটা মোদ্দা বিবরণ পাওয়া যায়, আগে তা কল্পনা করা যেত না। সুতরাং কোনো অনুষ্ঠান কোনো সম্প্রদায়ের এ চিন্তাটাও সাম্প্রদায়িক, যেটা নবান্ন উৎসবের বিরোধী।

কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় প্রধান শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে যেকোনো ঋতুতে এ উৎসব পালিত হয়। অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি, সন্তান ও পশুসম্পদ কামনা এ উৎসব প্রচলনের প্রধান কারণ। উত্তর-পশ্চিম ভারতে নবান্ন উৎসব পালিত হয় বৈশাখ মাসে। সেখানে রবিশস্য গম ঘরে তোলার আনন্দে এ বৈশাখী নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। দক্ষিণ ভারতেও প্রচলিত আছে এমনি ধরনের নবান্ন উৎসব। তারা ধান ও যব ঘরে তুলে এ উৎসব করে। অর্থাৎ বিষয়টা কৃষিও কৃষক সংলগ্ন এটা এক কথায় বলা যায়। বাংলাদেশের কয়েকটি আদিবাসীও তাদের ধান ফসল ঘরে তোলার সময় নবান্ন উৎসব পালন করে। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদযাপন করে উৎসব। তারা সাতদিন সাত রাত গানবাজনা এবং মদ্যপানের মাধ্যমে এ উৎসব পালন করে। উসুই জাতিগোষ্ঠী অন্নদাত্রী লক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাইলুকমা উৎসব পালন করে। জুম চাষি ম্রো উপজাতি চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভোজন করায়। ফসল তোলার পর গারোরা ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে পালন করে পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ওয়ানগাল্লা উৎসব।

হেমন্তে আমন ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ কিংবা পৌষ মাসে গৃহস্থরা এ উৎসব পালনে মেতে উঠত। উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল নতুন চালে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা। পরে দেবতা, অগ্নি, কাক, ব্রাহ্মণ ও আত্মীয়স্বজনদের নিবেদন করে গৃহকর্তা ও তার পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করতেন। এ উপলক্ষে বাড়ির প্রাঙ্গণে ঘরে-বাসায় আলপনা আঁকা হতো। পিঠা-পায়েসের আদান-প্রদান এবং আত্মীয়স্বজনের আগমনে পল্লির মেঠো পথ প্রতিটি গৃহের পরিবেশ হয়ে উঠত আনন্দঘন মধুময়। সর্বত্র চালের গুঁড়ি কোটার শব্দ, শাঁখের শব্দে গ্রামাঞ্চল হয়ে উঠত প্রাণবন্ত। পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে বসত কীর্তন, পালাগান ও জারিগানের আসর। অগ্রহায়ণ মাসের উত্থান একাদশীতে মুখোশধারী বিভিন্ন দল রাতভর বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাচগান করত। কৃষকরা নতুন ধান বিক্রি করে নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ কিনত। বর্তমানে সেসবের অনেক কিছুই লোপ পেয়েছে। এখন সংক্ষিপ্তভাবে কেউ কেউ এ উৎসব পালন করে।

নবান্ন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। তবে অনেক ইতিহাসবেত্তা নবান্ন উৎসবকে হিন্দুয়ানী উৎসব বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, এ উৎসবের প্রধান অঙ্গ নতুন চালের তৈরি নানা উপকরণে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন। এরপর দেবতা, অগ্নি, কাক, ব্রাহ্মণ আত্মীয়স্বজনকে নিবেদন করে গৃহকর্তা ও তার পরিবার নতুন গুড়সহ নবান্ন গ্রহণ করে। এ উপলক্ষে বাড়ির প্রাঙ্গণে আলপনা আঁকা হয়। এ সময় পিঠা-পায়েসের আদান-প্রদান আর আত্মীয়স্বজনের আগমনে পল্লীর গৃহপরিবেশ হয়ে ওঠে মধুময়। পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে বসে কীর্তন, পালাগান ও জারিগানের আসর। তবে আমাদের মনে হয় নবান্ন সবকালেই কৃষক, মেহনতি মানুষের উৎসব ছিল। প্রাচীন ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে এটা যেভাবে পালন করত সেটাকে হিন্দুয়ানী বলে খারিজ করা যাবে না। কৃষি পেশার সাথে হিন্দু কৃষক ক্ষেত মজুর বেশি যুক্ত থাকার কারণে হয়তো তাদের মতো করে, পিতৃপুরুষকে স্মরণ করে তার আগামী ফসল যাতে আরো ভালো হয় তা কামনা করতেন। আবার মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে মসজিদে শিরনি দিয়ে শুরু হতো এ উৎসব। পিঠা-পায়েস খাওয়ার উৎসব হতো। পাইট খেলা হতো ইত্যাদি।


সুন্দরবন তারা হিন্দু-মুসলিম-সাঁওতাল সবাই ভালো থাকার জন্য, আগামীতে বেশি শস্যের কামনায় তার সত্য পীরের শিরনি দিত। বনদেবীর পালা বা গাজী-কালুর পালা করত।

আদিবাসী অন্যান্য সম্প্রদায়ও তাদের প্রধান ফসল ঘরে তোলার পর ভিন্ন ভিন্ন নামে আর নিজস্ব রীতিতে নবান্ন উৎসব পালন করে। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদযাপন করে সোহরায় উৎসব। তারা সাতদিন সাত রাত গান-বাজনা ও হাড়িয়া (নিজেদের তৈরি মদ) পানের মাধ্যমে বিভোর থাকে এ উৎসবে। উসুই আদিবাসী অন্নদাত্রী লক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাইলুকমা উৎসব পালন করে। জুমচাষি ম্রো আদিবাসীরাও চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভূরিভোজ করায়। ফসল তোলার পর গারো আদিবাসীরা ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে পালন করে পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ওয়ানগাল্লা উৎসব। উৎসবের একটি বিষয় সর্বজন গ্রাহ্য তা হলো উৎসবের মূলে রয়েছে প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক অবস্থান ও ফসলের প্রকার ভেদ।

প্রাচীনকালে অন্য অঞ্চলের নিয়ম কানুন আরেক অঞ্চলে জানা কষ্টসাধ্য ছিল বলে এক এক অঞ্চলের উৎসবের উপাচারে ভিন্নতা আছে। তবে কৃষক-মজদুর শ্রেণির উৎসব ফসল কেন্দ্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ । এসব উৎসবের মধ্য দিয়ে মনে হয় নবান্নের মতো অসাম্প্রদায়িক উৎসব চালু করেছে কৃষক, ক্ষেতমজুর মেহনতি মানুষ। আমাদের অঞ্চলের কৃষক, শ্রমিক ,ক্ষেতমজুর যে কোনকালে সাম্প্রদায়িক ছিলো না, তার প্রমাণ ফসল কেন্দ্রিক উৎসব। সাম্প্রদায়িকতা চালু করেছে বিত্তবানেরা। মানুষকে যারা ভাগ করেছে তারা নিরক্ষর কৃষক নয়। তাহলে নবান্নসহ কোন উৎসব আমরা পেতাম না। সব সম্প্রদায় যে নবান্ন উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে এমন নয়। তবে নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দ কম-বেশি সবাইকে স্পর্শ করে, কিছুটা হলেও দেয় উৎসবের আনন্দ। তাই ইতিহাসের ধূসর পথরেখা ধরে সজীব বর্তমানে এলেও মনে দোলা দেয় একটি লাইন ‘নতুন ধান্যে হবে নবান্ন’।

অগ্রহায়ণের নতুন ধান ঘরে আনার আগে মা লোক দিয়ে মাটি এবং গোবর গুলিয়ে বাড়ির আঙিনা ও ধানের গোলা লেপে পরিপাটি করতেন। লোকজন নতুন ধানের আঁটি মাথায় করে এনে ফেলত লেপে রাখা ওই উঠোনে। এরপর মাড়াই করে ধান রোদে শুকিয়ে মচমচে করা হতো। মা সেই ধান ঢেঁকিতে পিষে চাল তৈরি করতেন। এরপর সন্ধ্যায় ওই চাল গুঁড়া করে তৈরি করা হতো পিঠা-পায়েস। এক সময় ঢেঁকির সুরেলা শব্দ ফুটিয়ে তুলত নবান্ন উৎসব। আগে নবান্ন উৎসবে খাবার খাওয়ার প্রতিযোগিতা করা হতো। যে যত বেশি খেতে পারত তাকে উপহার দেওয়া হতো। নগরায়ণ আর আধুনিকতার অজুহাতে বিলীন হয়েছে খেলার মাঠ। তেমনি গ্রামীণ জনপদে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ আছে, কিন্তু কৃষকের ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী আগেও নবান্নের ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা।

গ্রামীণ জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন শুধুই স্মৃতি। আগে কৃষকের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল আমন ধান। বর্তমানে আমনের জায়গা দখল করেছে আউশ-আমন-বোরো ধান। বিভিন্ন জাতের উচ্চফলনশীল ধান বাজারে আসায় নতুন ধানের গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে এবং স্বল্প সময়ে ওইসব ধান উৎপন্ন হওয়ায় গ্রামবাংলার ঐত্যিবাহী নবান্ন উৎসব হারিয়ে যেতে বসেছে। ধানের বীজ থেকে চাল উৎপাদন হওয়া পর্যন্ত সব কাজই এখন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হচ্ছে। এখন ধান উৎপাদনে আগের সেই পরিশ্রমও যেমন নেই, তেমনি চালের মজাও নেই।

উৎপাদনশীল মানসিকতার মধ্যে যে স্বাভাবিক নিবেদন আছে, তা নবান্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়; যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে ভক্তি, প্রেম ও লোক-সংস্কৃতির আবহমান বহুমাত্রিক মনোভঙ্গি। আর এসব মিলেমিশে পুষ্টি লাভ করেছে নবান্ন নামের লোক উৎসবটি।

হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যায় সোনালি ধানের ক্ষেত। পাকা ধানের সোনালি রং দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভরে যায়। এই শোভার কারণ, কৃষকের ঘর ভরে উঠবে গোলাভরা ধানে। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেকরকমের খাবার, বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের ম-ম গন্ধে ভরে ওঠে। এ কথা তাকে শেখাবে কে? গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে শহর, আমাদের উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে পেশা। এর মধ্য দিয়ে আমাদের নাগরিক লোক উৎসব করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে হচ্ছে। এটাকে ফেরানো যাবে না। তবে উৎসবকে ধরে রাখতে দরকার আন্তরিকতা। এসব লোক উৎসবকে বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে তাড়ানোর অন্য কোনও মন্ত্র নেই।

Post a Comment

0 Comments