Welcome To Sundarban TV ||সুন্দরবন টিভিতে আপনাকে স্বাগত || সুন্দরবন টিভি সুন্দরবনের মানুষের জীবন কথা

ম্যানগ্রোভ বন্ধন

ম্যানগ্রোভ বন্ধন 



উমাশঙ্কর মন্ডল,গোসাবা - দক্ষিণ ২৪ পরগনা 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, উপনিষদের সব পুরুষ ঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটি নারীর ব্যাকুল বাণী ধ্বনিত-মন্ত্রিত হয়ে উঠেছে - যা কখনোই বিলীন হয়ে যায়নি৷ তিনিও জানতেন,

অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়...
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম৷

অর্থাৎ, হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও; হে প্রকাশ, তুমি একবার আমার হও, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক৷

"অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে , তুমি বৃক্ষ , আদিপ্রাণ ;
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ- ‘ পরে ; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে ।
সেদিন অম্বর-মাঝে
শ্যামে নীলে মিশ্রমন্ত্রে স্বর্গলোকে জ্যোতিষ্কসমাজে
মর্তের মাহাত্ম্যগান করিলে ঘোষণা" । 

বৃক্ষবন্দনা -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঠিক কবে থেকে এই উৎসবের প্রচলন হয়েছিল তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এই প্রথা যে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে তলে আসছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পবিত্র সুতোর বন্ধনকে রক্ষা কবজ হিসেবে দেখা হয়। বিভিন্ন দেব দেবীর রক্ষাসূত্র হিসেবে বিভিন্ন মন্দিরে ভক্তদের হাতে পবিত্র সূতো বেঁধে দেওয়া হয়। আবার ব্রাহ্মণরা যে উপবীত ধারণ করেন, তাও রক্ষাসূত্র হিসেবেই দেখা হয়। এমনকী হিন্দু বিবাহে যে মঙ্গলসূত্র পরানোর প্রথা প্রচলিত আছে, তাও স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য স্বামীর অজ্ঞিকারের চিহ্ন।
রাখি বন্ধনের প্রথম নজিরটি পাওয়া যায় হিন্দু পুরাণে। দেবরাজ ইন্দ্রকে অসুর ও তাঁর শত্রুদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে হাতে রাখি পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সেই রাখি কিভাবে ভাই-বোনের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে তা জানা যায়নি। মূলতঃ হিন্দুদের উৎসব হলেও, এই উৎসব আজ সারা ভারতে, এমনকী ভারতের বাইরেও সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তবে এর মধ্যেই  তিন রকম বিষয় আছে | এক রামাযানে রাম সমস্ত বানর সেনাদের ফুল দিয়ে রাখি বেধে ছিলেন | দুই লক্ষ্মী বলিকে ভাই হিসেবে মেনে রাখি পরিয়েছিল যাতে সে উপহার স্বরূপ বিষ্ণুকে স্বর্গে তার কাছে ফিরে যেতে বলে | তিন সাম্প্রদায়িকতা মেটাতে রবীন্দ্রনাথ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে রাখি বন্ধন উৎসব প্রচলন করেন | যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২ এর নিয়মই পালন করা হয় | এই নিয়মটি যদিও একটি একাধিপত্যের বার্তা বহন করে |এই সম্পর্কে মানুষকে সচেতন হতে হবে | এখন অবশ্য জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন ধরনের রাখি উৎসব পালন করা হয় ,সেটা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে |
রক্ষা বন্ধন উৎসবে ভাইবোনের মধ্যকার স্বর্গীয় সম্পর্ক উদযাপন করা হয়। রাখী নামেও পরিচিত এই রক্ষা বন্ধন প্রতি বছর শ্রাবন মাসের পূর্ণিমার দিন পালন করা হয়। বোনেরা তাদের ভাইদের হাতের কব্জিতে সুন্দর সুন্দর পবিত্র সূতা বেঁধে দেয় যা ‘নিরাপত্তা ও রক্ষা বন্ধন’ চিহ্ন হিসেবে প্রকাশিত। তারা তাদের ভাইদের মঙ্গল কামনা করে এবং ভাইয়েরা বোনদের রক্ষা করা প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। ঐ দিন পরিবারের সকলে একত্রে মিলিত হয়, বিশেষ খাবার দাবারের ও উপহারের ব্যবস্থা করা হয় এবং সকলে মিলে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে ওঠে। এই বিশেষ দিনে পরিবেশে “যম” তত্ত্ব বেশি থাকে, এতে ভাইয়ের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, কিন্তু রাখি বন্ধনের ফলে তা দূর হয়ে যায়।
রাখি বন্ধনের নেপথ্যের ইতিহাস:
সুভদ্রা কৃষ্ণের ছোট বোন, কৃষ্ণ সুভদ্রাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তবে আপন বোন না হয়েও দ্রৌপদী ছিলেন কৃষ্ণের অতীব স্নেহভাজন। একদিন সুভদ্রা কিছুটা অভিমান ভরে কৃষ্ণকে প্রশ্ন করলেন এর কারন। উত্তরে কৃষ্ণ বললেন যথা সময়ে এর কারন তুমি বুঝতে পারবে।
এর কিছুদিন পর শ্রীকৃষ্ণের হাত কেটে রক্ত পড়ছিল, তা দেখে সুভদ্রা রক্ত বন্ধের জন্য কাপড় খুঁজছিলেন, কিন্তু মন মত পাতলা সাধারন কাপড় পাচ্ছিলেন না, এর মাঝে দ্রৌপদী সেখানে আসলেন, দেখে বিন্দুমাত্র দেরি না করে সাথে সাথে নিজের মুল্যবান রেশম শাড়ি ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাত বেধে দিলেন, কিছুক্ষন পর রক্তপাত বন্ধ হল। তখন শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রা কে ডেকে বললেন- এখন বুঝতে পেরেছ কেন আমি দ্রৌপদীকে এত স্নেহ করি? সুভদ্রা বুঝতে পারল ভক্তি ও পবিত্র ভালবাসা, শ্রদ্ধা কি জিনিস! দাদা কৃষ্ণের চেয়ে মুল্যবান বস্ত্র নিজের কাছে বেশি প্রিয় এটা ভেবে সুভদ্রা দারুন লজ্জিত হলেন। কোন বোন তার ভাইয়ের কোনোরূপ কষ্ট, অমঙ্গল সহ্য করতে পারে না। ভাইয়ের কষ্ট দুরের জন্য সে সর্বত্তম চেষ্টা করে। অন্যদিকে ভাই ও তার বোন কে পৃথিবীতে সর্বাধিক স্নেহ করে, সারাজীবন তাকে রক্ষা করে থাকে, যেরকম শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে রাজসভায় চরম কলঙ্ক থেকে রক্ষা করেছিলেন। সকল ভাইবোনের উচিত এই পবিত্র দিনে মনে এরকম ভক্তিভাব ও ভালবাসা বজায় রাখা। কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতার এই বর্তমান যুগে ভাই বোনের মাঝে ভালবাসা ও শ্রদ্ধার বড় অভাব। সনাতন ধর্মে বড় বোন/দিদিকে মাতৃস্থানীয় এবং বড় ভাইকে পিতৃস্থানীয় সম্মান ও ভালবাসা দেয়ার কথা বলা আছে।
আবার ভারতের ইতিহাসে অবশ্য বিভিন্ন সময় রাখিকে ব্যবহার করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও। শোনা যায় খ্রীস্টপূর্ব ৩২৬ সনে হিদাসপাসের যুদ্ধের আগে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোক্সানা পুরুকে রাখি পাঠিয়েছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন যুদ্ধে পুরু যেন আলেকজান্ডারের কোনও ক্ষতি না করেন। সেই রাখির পবিত্রতাকে সম্মান জানিয়েছিলেন পুরু। যুদ্ধে তিনি আলেকজান্ডারকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখেন নিজেকে।


 হুমায়ুনের শাসনকালে চিতোরের রানী কর্ণাবতী হুমায়ুনকে রাখি পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় বাহাদুর শাহের বাহিনী চিতোর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল। রাজ্যকে রক্ষা করতে রাখি পাঠিয়ে হুমায়ুনের সাহায্য চেয়েছিলেন চিতোরের রানী। শোনা যায়, হুমায়ুনও সেই রক্ষা বন্ধনকে সম্মান করেছিলেন। চিতোর রক্ষা করতে পাঠিয়ে দেন তাঁর বাহিনীকে।
আবার ১৯০৫ সালে প্রথমবার যখন বাংলা ভাগের চক্রান্ত করেছিল ইংরেজরা, দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল হিন্দু, মুসলমানের মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ধরে রাখতে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাখি বন্ধনের। হিন্দু -মুসলমান পরস্পর পরস্পরের হাতে রাখি পরিয়ে নিজেদের সম্প্রীতি প্রকা করেছিলেন। ইংরেজদের চক্রান্তের মুখে অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাখি।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে রাখির বাহ্যিক অনেক কিছুই। আজ আর কেবল রঙিন সুতো নয়,  অন্তরঙ্গে এখনও রাখি সেই রক্ষা কবজের পবিত্রতা বহন করে। সেই পবিত্রতাকে স্মরণ করে আজকের বিক্ষুব্ধ সময়ে দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বন্ধেও রাখি রক্ষাকবজ হয়ে উঠবে এই আশা।
বনমহোৎসব প্রকৃত অর্থে বৃক্ষ রোপণ উৎসব।
বনমহোৎসব বৃক্ষ বা তরু বন্দনা। মানবের স্নেহবন্ধনে বৃক্ষকূলকে আপন করে নেবার উৎসব। উদ্ভিদ জগতের বন্দনাগান। বনমহোৎসব বিশ্ব প্রকৃতির সংরক্ষণে সংকল্প গ্রহণের উৎসব।
বনমহোৎসবের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রথমেই শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্র নাথের প্রসঙ্গ উঠে আসবে। পরিবেশ সচেতনতা’র বার্তা দিকে দিকে পৌঁছে দিতে রবীন্দ্রনাথ—বন মহোৎসব’এর সূচনা করেছিলেন শান্তি  নিকেতনে সেই ১৯২৭ সালে ‘বৃক্ষ রোপণ’ অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে ।

অরণ্য ছাড়া জীবন অর্থহীন। পঞ্চভূতে গঠিত মানব শরীর। বনরাজিও পঞ্চভূতের সম্মিলিত রূপ। পঞ্চভূত হল ক্ষিতি,অপ,তেজ,মরুৎ,ব্যোম। মাটির আশ্রয়ে গগনমুখী বৃক্ষ জল,হাওয়া ও তেজ,অর্থাৎ আলোর আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে। বন ছাড়া মানুষের জীবন শুষ্ক। শান্তিনিকেতনে বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে বনমহোৎসবের আয়োজনে রবি কবি বললেন,
 “আয়, আয় আমাদের অঙ্গনে, অতিথি বালক তরুদল
মানবের স্নেহ সঙ্গ নে, চল্, আমাদের ঘরে চল্‌”………।
আবার বললেন,  “ফিরে চল্‌ ,ফিরে চল্‌,ফিরে চল্‌ মাটির টানে”
ইঁট কাঠের ভবনের  মধ্যে আবদ্ধ  মানুষকে দেখে কবির খেদোক্তি, “ ইঁটের পরে ইঁট, মাঝে মানুষ কীট,নাইকো ভালবাসা, নাইকো খেলা”। তাই মনে হয়, বাঁচার তাগিদে বৃক্ষ রোপণ যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। 
কবিগুরুর সংগে সুর মিলিয়ে আজ আমরাও বলি –“দাও ফিরে সে অরণ্য,লও এ নগর”।
স্বাধীন ভারতে বনমহোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন  ১৯৫০ সালে তদানীন্তন কৃষি মন্ত্রী কে এম মুন্সী রাজধানী দিল্লি সহ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে। এতে রাজেন্দ্র প্রসাদ ও জওহর লাল নেহেরুর মত বহু জাতীয় নেতা অংশ নেন। এর পর চিপকো আন্দোলনের জনপ্রিয়তা প্রসারের সাথে সাথে বনমহোৎসব অনুষ্ঠানও  দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে –
কি সেই চিপকো আন্দোলন?
গাছকে আলিঙ্গন ক’রে, গাছের চার পাশে বৃত্তাকার মানব শৃঙ্খল রচনা ক’রে টিম্বার মাফিয়াদের কবল থেকে তাকে রক্ষা করার প্রয়াস এবং একে এক গণ জাগরণের রূপ দানই চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের বীজ উপ্ত হয় উত্তর ভারতের প্রত্যন্ত এক পাহাড়ি অঞ্চলে।
ভাবতে অবাক লাগে, এই পাহাড়ী অঞ্চলের ‘কোনও এক গাঁয়ের বধুরাই এই অসাধ্য সাধন করতে এগিয়ে এসেছিলেন ।  তাঁদের  মনে হয়ত একদিন আশংকা জেগেছিল, এই ভাবে নির্বিচারে গাছ কেটে ফেললে তাঁদের  জীবন জীবিকার  প্রধান আশ্রয় যে অরণ্য তা দ্রুত হ্রাস পাবে; তাঁদের  অস্তিত্বই একদিন বিপন্ন হয়ে পড়বে।
এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে যাঁরা এগিয়ে এলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম  প্রবাদ প্রতীম প্রকৃতি প্রেমী, পরিবেশবিদ সুন্দর লাল বহুগুণা।
সেই সব গ্রাম্য বধূদের  হয়তো অক্ষর জ্ঞানও ছিল না। কিন্তু তাঁদের  ছিল দৃঢ় প্রত্যয়, বজ্র কঠিন সংকল্প; তাই তাঁদের  সামনে  টিম্বার মাফিয়ারা শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। সরকারও বনাঞ্চল রক্ষার ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা ভাবনা শুরু করার প্রয়োজন অনুভব করে। প্রকৃত অর্থে চিপকো আন্দোলন ভারতে পরিবেশ সচেতনতা অভিযানের প্রসারে এক যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তার করে; বিশ্ব প্রকৃতির সংরক্ষণে মানুষের চিন্তা ভাবনায় এক মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
বনমহোৎসব’এর আলোচনায় গ্রাম বাংলার একটি সুপ্রাচীন প্রথার উল্লেখ এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বহু স্থানে এমন সব গাছ রয়েছে, বিশেষ করে অশ্বত্থ ও বট গাছ, যেগুলি স্থানীয় জনসাধারণের  কাছে অত্যন্ত সম্ভ্রম, অত্যন্ত শ্রদ্ধার বস্তু। এগুলিকে “প্রতিষ্ঠা” করা গাছ বলা হয়ে থাকে। রীতিমত ধর্মীয় অনুষ্ঠান সহযোগে স্থানীয় বয়স্ক পুরুষ বা মহিলা এগুলি প্রতিষ্ঠা ক’রে থাকেন। প্রতি বছর বৃষ্টি বিহীন বৈশাখ মাসে ‘দীর্ঘ দগ্ধ দিন’এর  প্রতি সকালে শুদ্ধাচারে এই সব গাছের গোড়ায় পাত্র ভর্তি জল অর্পণ করা হয়ে থাকে। বৃক্ষের তৃষ্ণা নিবারণের এটি নিছক একটি  প্রতীকী প্রচেষ্টা।  তবে এই সনাতন প্রথা উদ্ভিদ জগতের সংগে মানবের নিবিড় বন্ধন, পরস্পরের  প্রতি স্নেহ, ভালবাসা ও মমত্ববোধের উজ্জ্বল উদাহরণ।
সাহিত্যেক,ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক বন্ধনের কথা আমরা জানলাম,এবার আসি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনভূমির কথা, ম্যানগ্রোভ বনভূমি এখন  বিপদের মুখে। ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের কথা ভাবলেই শরীর শিউরে উঠে। প্রয়োজন মানুষের  সাথে আরো নিবিড় বন্ধন। 
গত আট বছরে ৪৩ বর্গ কিমি ম্যানগ্রোভ অরণ্য বা বাদাবন হারিয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে সবচেয়ে কার্যকর ‘খুব গভীর ম্যানগ্রোভ’ এলাকাই কমেছে ৪২ বর্গ কিমি। সুন্দরবন সহ দেশের সব অরণ্যভূমিতে দু’বছর অন্তর সমীক্ষা চালানো হয়। তখনই হয় সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, বাইন, কেওড়া সহ ম্যানগ্রোভ এলাকার সমীক্ষাও। পোশাকি নাম ফরেস্ট সেন্সাস। ইন্ডিয়ান স্টেট অব ফরেস্ট রিপোর্ট এই ফরেস্ট সেন্সাসের দায়িত্বে। তার রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলিকে পাঠানো হয়। সর্বশেষ সমীক্ষা হয়েছে ২০১৯-এ। তার রিপোর্ট বেরিয়েছে সম্প্রতি। রিপোর্টটি রাজ্যের বন দপ্তরেও পৌঁছেছে। সেই রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১১-র সমীক্ষায় সুন্দরবনে বাদাবনের এলাকা ছিল ২১৫৫ বর্গ কিমি। ২০১৯-র সমীক্ষায় নেমে এসেছে ২১১২.১১ বর্গ কিমিতে। ১৯৮৭-র পর লাগাতার রাজ্যে ম্যানগ্রোভের পরিমাণ বেড়েছিল। ১৯৮৭-তে ছিল ২০৭৬ বর্গ কিমি। কিন্তু গত সাত-আট বছর ধরে তা কমার দিকে। তিন ধরনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য হয়— ‘খুব গভীর বাদাবন’, ‘মাঝারি গভীর বাদাবন’ এবং ‘ওপেন ম্যানগ্রোভ জোন’। বিপর্যয় মোকাবিলায় সবচেয়ে শক্তিশালী প্রথম দুই এলাকার ম্যানগ্রোভ। প্রথম দু’টি কমতে থাকলে তৃতীয়টি বাড়ে। কারণ, তখন গভীর বনাঞ্চল ফাঁকা ও মাঝে মাঝে ন্যাড়া এলাকায় পরিণত হয়। পশ্চিমবঙ্গে কমেছে এই দুই এলাকার ম্যানগ্রোভ। বেড়েছে যা, তা হলো অপেক্ষাকৃত পাতলা (ওপেন এরিয়া) ম্যানগ্রোভ— যার মাঝে মাঝে টাকের মত ফাঁকা এলাকা। দূরে দূরে গরান, গেঁওয়া, বাইনের ভিড়। বন দপ্তরের এক অফিসার জানিয়েছেন, ‘‘খুব গভীর, মাঝারি গভীর ম্যানগ্রোভ কমছে। স্বাভাবিকভাবেই সেই এলাকা পরিণত হচ্ছে ওপেন এরিয়ায়। তা বাড়ছে। যা আসলে বিপদের বার্তা দিচ্ছে।’’ কেন মরছে বাদাবন? কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। জলে নুনের পরিমাণ বাড়ছে। বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নেয় বাদাবন। পরিবেশে লাঘব করে দূষণের ভার। সেই কার্বন ডাই অক্সাইডকে বাদাবনের লবণাক্ত জলের উদ্ভিদ গ্লুকোজে রূপান্তরিত করে। তার প্রভাবেই বেড়ে চলে ম্যানগ্রোভ। কিন্তু একদিকে পুরানো গাছের কার্বন ডাই অক্সাইড টানার ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে কমছে, অন্যদিকে ম্যানগ্রোভের পরিমাণও কমছে, ফলে বাড়ছে দূষণ। আবার লাগাতার নুনের পরিমাণ বাড়ছে বলে ক্ষতি হচ্ছে গাছের, নতুন গাছের জন্মের। মিষ্টি জল সমতল থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া বিদ্যাধরীর মতো নদীগুলির মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উপকূল সংলগ্ন জনপদে লাগামছাড়া নির্মাণ, বর্জ্য নিষ্কাশন, নদীতে এন্তার জ্বালানি তেল ছড়ানোর মতো কাজগুলিই ক্রমশ বাদাবনের বিস্তীর্ণ এলাকা ফাঁকা করে দিচ্ছে। রাজ্যের বন দপ্তরের এক অফিসার জানিয়েছেন, ‘‘রাজ্যের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মতামত, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সংস্থার রিপোর্টেও এই বিপদগুলির কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।’’ আর একটি কারণ আর্থ-সামাজিক। সুন্দরবনের বাদাবন সংলগ্ন দ্বীপাঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যা লাগাতার বাড়ছে। কাজের অভাব, সরকারের নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব গ্রামবাসীদের আরও বেশি করে অভয়ারণ্য নির্ভর করে তুলছে। তার প্রভাব পড়ছে বাদাবনে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের ম্যানগ্রোভ-রিপোর্ট এই ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। খুব গভীর ম্যানগ্রোভ দেশের তিনটি রাজ্যের উপকূলে দেখা যায়। সেগুলি হলো পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা এবং আন্দামান-নিকোবর। পশ্চিমবঙ্গে এই ম্যানগ্রোভ এলাকা অনেকটাই কমেছে। ২০১১-তে খুব গভীর ম্যানগ্রোভ ছিল ১০৩৮ বর্গ কিমি। ২০১৯-এ তা কমে হয়েছে ৯৯৫.৬২ বর্গ কিমি। মাঝারি ম্যানগ্রোভ এলাকা রাজ্যে ২০১১-তে ছিল ৮৮১ বর্গ কিমি। ২০১৯-এ তা নেমে এসেছে ৬৯২ বর্গ কিমি এলাকায়। খোলা ম্যানগ্রোভ এলাকা ২০১১-তে ছিল ২৩৬ বর্গ কিমি এলাকা। তা ২০১৯-এ হয়েছে ৪১৯.৫০ বর্গ কিমি। রাজ্যের তিনটি জেলায় ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব আছে— দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুর। কিন্তু সর্বশেষ সমীক্ষায় স্পষ্ট, পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল থেকে ম্যানগ্রোভ বিলুপ্ত হতে বসেছে। ২০১১-তে সেখানে ১১ বর্গ কিমি ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব মিলেছিল, এখন তা নেমে এসেছে ৪ বর্গ কিমি এলাকায়। ২০১১-তে পূর্ব মেদিনীপুরের বাদাবনের মধ্যে ‘খুব গভীর ম্যানগ্রোভ’ ছিল ৪ বর্গ কিমি, ‘মাঝারি গভীর ম্যানগ্রোভ’ ছিল ২ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে। এর মধ্যে প্রথম ভাগটির আর অস্তিত্ব নেই। ‘মাঝারি গভীর ম্যানগ্রোভ’-এর এলাকা এখন দাঁড়িয়েছে ১ বর্গ কিমি-তে। বাদাবনের ক্ষেত্রে পূর্ব মেদিনীপুরে পাতলা এলাকা (ওপেন এরিয়া) ম্যানগ্রোভ ২০১১-তে ছিল ৫ বর্গ কিমি এলাকায়। সর্বশেষ পর্যালোচনায় তা নেমে এসেছে মাত্র ৩ বর্গ কিমি এলাকায়। অদূর ভবিষ্যতে পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূল বাদাবনহীন হতে চলেছে, এমনই আশঙ্কা করছেন রাজ্যের সমুদ্র বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী, বিশেষজ্ঞরা। বাদাবন রয়েছে বাকি দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকায়। তার মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনাই প্রধান। এখানে ২০১১-তে মোট ম্যানগ্রোভ এলাকা ছিল ২১১৮ বর্গ কিমি। তা নেমে এসেছে ২০৮২.১৭ বর্গ কিমিতে। এই জেলায় বিপুল পরিমাণ খুব গভীর এবং মাঝারি গভীর ম্যানগ্রোভ কমেছে। ২০১১-তে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় খুব গভীর ম্যানগ্রোভ এলাকা ছিল ১০১৪ বর্গ কিমি। তা নেমে এসেছে ৯৮২.৬৫ বর্গ কিমিতে। এই জেলায় মাঝারি গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্য এলাকা আট বছরে ৮৭৩ বর্গ কিমি থেকে কমে ৬৮০ বর্গ কিমি এলাকায় নেমে এসেছে। বেড়েছে ‘খোলা ম্যানগ্রোভ এলাকা’, যা প্রধানত গভীর এবং মাঝারি গভীর হালকা হওয়ার ফল। উত্তর ২৪ পরগনাতেও কমেছে বাদাবন। এই জেলায় খুব গভীর বাদাবন আট বছরে ২০ বর্গ কিমি থেকে নেমে এসেছে ১২.৯৭ বর্গ কিমিতে। মাঝারি গভীর বাদাবন বেড়েছে ৪ বর্গ কিমি। বেড়েছে খোলা এলাকাও। খুব গভীর ম্যানগ্রোভ এলাকা কমে যাওয়াই দুয়েরই কারণ।
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো”।
প্রকৃতির শক্তিকে মানুষ যে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে পৃথিবীকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে রবীন্দ্রনাথ সে কথাও বলে গিয়েছিলেন, অথচ এ ভারসাম্যের ব্যাঘাতের জন্যই আজ বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, এই জলবায়ু পরিবর্তন আজ বিশ্ব-সমস্যা। জলবায়ুর এই অসম পরিবর্তন ও বিষ-উষ্ণতা যদি না ঠেকানো যায় তবে হয়ত আর অল্প কিছু কালের মাঝেই এ ধরিত্রী বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
আমরা এখন  সেই আকুল শ্রাবণ নেই, তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে, শীতকালে হচ্ছে অকাল বৃষ্টি, শরতের সেই মনোহর রূপ আজ উধাও হতে যাচ্ছে। মানুষের অপরিসীম লোভ প্রকৃতিকে করে তুলেছে ভারসাম্যহীন। নির্বিচারে বন উজাড়, গাছ কাটা, ব্যাপকহারে নগরায়ন ও শিল্পায়ন ও এর উদ্ভূত বিরূপ উপজাত- বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন পরিবেশের জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
বনবাণীর ‘বৃক্ষবন্দনা’ পরিবেশবাদী চিন্তাবিদদের কাছে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা; কারণ গাছ রক্ষা বর্তমান পরিবেশবাদীদের কাছে অন্যতম প্রধান বিষয়। একদিকে গাছ আমরা নির্বিচারে নিধন করছি; আবার বলছি এই গাছকে রক্ষা করতে হবে আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আশ্রয় নেন গাছের কাছে তার সংগীতময় উৎসবে: “বৃক্ষবন্দনা”
…বাণীশূন্য ছিল একদিন
জলস্থল শূন্যতল, ঋতুর উৎসবমন্ত্রহীন–
শাখায় রচিলে তব সংগীতের আদিম আশ্রয়,
যে গানে চঞ্চল বায়ু নিজের লভিল পরিচয়,…
প্রতিটা প্রকৃতির রোষে, প্রতিটা ভয়াবহ দুর্যোগে সেই কথাটাই যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ‘অতি-উন্নত’ আবার ‘অতি-নির্বোধ’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীব মানুষ । যাঁরা নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেরাই একটু একটু করে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে ।
তবু প্রকৃতি-মা নিরলস তার কাজে, তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় । আজও গাছের শিকড়ে ভূমিক্ষয় আটকে, নদীর বুকে বন্যাকে ধারণ করে, ম্যানগ্রোভের আড়ালে সাইক্লোনকে যথাসাধ্য লুকিয়ে ফেলে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে আমাদের । সম্প্রতি সুপার সাইক্লোন ‘আমফান’-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছে আমাদের । সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ না থাকলে কোন ধ্বংসলীলা চাক্ষুস করতে হত মানবজাতিকে । ১৮০-১৮৫ কিমি গতিতে সুন্দরবনে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় বেগ কমিয়ে নেমে এল ১২০-১৩০-এ । কিন্তু সেই ম্যানগ্রোভই আজ বিপর্যয়ের মুখোমুখি । পরিবেশবিদরা বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের অতন্ত্র প্রহরী ম্যানগ্রোভ। 
 গরম যাচ্ছে  সৌরমণ্ডলের একমাত্র বাসযোগ্য এই গ্রহ । বরফ গলেছে হিমবাহের । জলস্তর বেড়েই চলেছে একটু একটু করে । আর সমুদ্রের সেই বেড়ে যাওয়া জলস্তরই অসনী সংকেত দিচ্ছে ম্যানগ্রোভকে ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন প্রতি বছর সমুদ্রের জলস্তর ৩.৫-৪ মিলি মিটার করে বাড়ছে । সেটা যদি বছরে ৬ মিলি মিটারের কাছাকাছি চলে আসে তা হলেই বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করবে ম্যানগ্রোভের । কারণ ওই পরিমাণ জলের মধ্যে নতুন গাছ আর জন্ম নিতে পারবে না ।
ম্যানগ্রোভকে সারা পৃথিবীর উপকূলের রক্ষাকর্তা বলা হয় । পাশাপাশি, জৈব বৈচিত্র ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও এর অবদান অসামান্য । বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, যদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কার্বোন নির্গমনে এখনই লাগাম না টানা যায় তা হলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে । তখন আর কিছুই করার থাকবে না ।
কবির ভাষায়
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,…
পূর্বাশার ম্যানগ্রোভ বন্ধন উৎসবে এগিয়ে এসেছেন 
সাতজেলিয়ার লাহিড়ীপুর অঞ্চলের চরঘেরী  লাহিড়ীপুর,সোনাগাঁ,সুকুমারী, কালিদাসপুর গ্রামের মায়েরা। পূর্বাশার এই মায়েরা নতুন ভাবে পথ দেখাবে। ওরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

Post a Comment

0 Comments