সুন্দরবনে কি ম্যানগ্রোভের জঙ্গল বেড়েছে নাকি বাঘের সংখ্যা ?

 

প্রশান্ত সরকার, ঝড়খালী –  গত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনের ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের আক্রমণ বেড়ে চলেছে। আর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আক্রমণের ফলে সুন্দরবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মৎস্য চাষ, প্রাণী পালন, সুন্দরবনের নদী বাঁধ, আর এইসব কিছুর ক্ষতির সীমানা ছাড়িয়ে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ সাড়া বিশ্বের মানুষের কাছে বর্তমান সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যেমন বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়ে চলেছে ঠিক তেমন অপরদিকে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ শিরদাঁড়া শক্ত করে পরিবেশকে রক্ষা করছেন।

 সুন্দরবনের কিছু অসাধু ব্যক্তি যারা নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধা পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নির্বিচারে কেটে চলেছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। বর্তমান সময়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করার জন্য  পর্যটকদের কাছে  উল্লেখযোগ্য ঠিকানা  হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ তাদের ভ্রমণের ঠিকানার তালিকায় সুন্দরবনকে স্থান করে নিয়েছে। এর ফলে অবশ্যই সুন্দরবনের মানুষের রুজি রোজগার বেড়েছে। কিন্তু অপরদিকে ভয়ানক বিপদের মুখে এগিয়ে চলেছে সুন্দরবন। পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণ করার সময় সুন্দরবনের নদীর বুকে ইঞ্জিন চালিত জলযান ব্যবহার করছেন। টুরিস্ট লঞ্চগুলি যখন জলের উপর চলার সময় হাল্কা তেলের আস্তরণ ছড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। এর ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জলের জীব বৈচিত্র। আগে একটা সময় লক্ষ্য করা যেত সুন্দরবনের লোকালের নদীর কিনারায় ছোট ছোট মিনিগুলির ঝাক, ছোট্ট ছোট্ট লাল কাঁকড়ার দল। এখনো অবশ্য এগুলি মাঝেমধ্যে খুব কম সংখ্যাই দেখা যায়। বর্তমান সময়ে পর্যটন ব্যবসা এতটাই বেড়ে গেছে এর ফলে প্রতিনিয়ত তেলবাহী লঞ্চ এগুলো চলছে নদী পথে। ফলে তেলের আবরণ জলের উপরে তৈরি হয়েছে। আর নষ্ট হচ্ছে জলের বাস্তুতন্ত্র। 

ঠিক তেমনভাবে জঙ্গলে ম্যানগ্রোভের সংখ্যা অনেকটাই কমতে বসেছে।  কারণ এই তেলের কারণে ম্যানগ্রোভের বীজ যখন জলের উপর দিয়ে ভেসে নদীর কিনারায় আসছে তখন তেলের আস্তরণের কারণে ম্যানগ্রোভের বীজগুলি সঠিকভাবে অঙ্কুরোদগম করতে সক্ষম হচ্ছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বীজ। এর ফলে একের পর এক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বহু প্রজাতির ম্যানগ্রোভের বীজ। তবে রাজ্য সরকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে এসেছেন ম্যানগ্রোভ রোপনের কাজে। এর ফলে একদিকে যেমন সুন্দরবনের মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে, তেমন বেড়েছে বিকল্প আয়। মান উন্নয়ন হয়েছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের। তবে সারা বছর এই কাজ না পাওয়ার জন্য অন্যদিকে বিপদের  সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। 
করোনা কালের আগে সুন্দরবনের বেশিরভাগই মানুষ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অথবা ভিন রাজ্যে বিভিন্ন ঠিকাদারের অধিনে শ্রমিকের কাজ করতেন।  কিছু সংখ্যক মানুষ আবার নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ সাথে পুকুরে মাছ চাষ করতেন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি কাজ  নষ্ট হয়েছে পুকুরের মাছ। ফলে আর তেমন কেউ ঝুঁকি নিয়ে কৃষিকাজ ও মাছ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাহলে সহজ উপায়ে উপার্জনের রাস্তা কি আছে? একটাই উপায় নদীতে মাছ কাঁকড়া ধরতে যাওয়া ও জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করা।  যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে জালে বেধে যেতে পারে বড় আকারের তেলে ভোলা মাছ। খুব সহজেই হওয়া যাবে লাখপতি।  বিষয়টি অবশ্য বহুবার ঘটেছে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের।  ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে এমনি আশা বহু মৎস্যজীবীদের। সুন্দরবনের কিছু সংখ্যক মানুষ  নিজেদের পেশা পরিবর্তন করেছেন। বেরিয়ে পড়েছেন জাল দড়ি নিয়ে মাছ কাকড়ার খোঁজে কেউবা মধু সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। হঠাৎ করে নিজেদের পেশা বদল করছেন। গভীর জঙ্গলের খারিতে মাছ কাঁকড়া ধরার কাজে বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। যে সমস্ত মানুষ হঠাৎ করে নিজেদের পেশাবদল করে মৎস্যজীবী হয়েছে তাদের মধ্যে যথেষ্ট দক্ষতার অভাব আছে। মাছ কাকড়া ধরার ও মধু সংগ্রহ করার বিশেষ কিছু নিয়ম পদ্ধতি ও পন্থা অবলম্বন করতে হয়। ফলে অদক্ষ মৎস্যজীবীর সংখ্যা  বেড়ে চলেছে।

 খুব স্বাভাবিকভাবেই অদক্ষ মৎস্যজীবীরা বাঘের শিকার হয়ে পড়ছেন। এভাবেই প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে সুন্দরবনের বাঘ বিধবাদের সংখ্যা, পিতা হারা  শিশুদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।  তবে এই বিপদের সংখ্যা কমাতে বন বিভাগের তরফ থেকে বিভিন্ন করা পদক্ষেপ ও আইন তৈরি করেছেন মৎস্যজীবীদের জন্য। বিভিন্ন মৎস্যজীবী সংগঠনগুলি সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি পেশ করেছেন বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য । অনেক মৎস্যজীবী পরিবার বিকল্প আয় হিসেবে বাড়িতে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু তৈরি করছেন যা বাজারে খুবই বিক্রি ও মূল্যবান। তবে সুন্দরবনে একদিকে যেমন  বাঘের আক্রমণের সংখ্যা কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন বন বিভাগ। তেমন অপরদিকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের সংখ্যা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে, সুন্দরবনের বাঘের কুমিরের সংখ্যা। তবে যেভাবে শহর এবং মফরসল এরিয়া থেকে বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে শহর ধোয়া নোংরা জল নদীর জলে মিশে যাচ্ছে, তা আগামী দিনের জন্য মোটেও সুখবর নয়। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন