নুরসেলিম লস্কর, বাসন্তী: এডস মুক্ত বিশ্ব-গড়ার লক্ষ্যে সাইকেল নিয়ে পৃথিবীর ভ্রমণ করছেন প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বাসন্তী ব্লকের বিস্ময় বালক সোমেন দেবনাথ। যার শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে! দিনটি ছিল ২৭শে মে ২০০৪ সাল। সোমেন যখন মাত্র বছর চোদ্দোর নাবালক, তখন সে এই ‘এডস ‘ নামক মারণ রোগ সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন। তারপর থেকে এই রোগের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে সোমেন জানতে পারে তার ভয়াবহতার কথা। সেই সঙ্গে জানতে পারেন যে, এই রোগের কোড়াল গ্রাসে পড়ে কিভাবে বিশ্বে একের পর এক মায়ের কোল খালি হয়ে যাচ্ছে। আর সেদিনই সোমেন মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, এই মারণ রোগ কে বিশ্ব থেকে বিতাড়িত করতে গেলে সাধারণ মানুষদের সবার আগে সচেতন করে তুলতে হবে। সেই শুরু! এডস নিয়ে সোমেন শুরু করলো তার পড়াশোনা। তার পর একদিন নিজের স্কুল জীবনের পড়াশোনা শেষ করে চলে গেলেন ‘রিজিওন্যাল এডস কন্টোল সোসাইটি’তে। সেখান থেকে নিলেন স্পেশাল প্রশিক্ষণ। তার পর কলেজ শেষ করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সোমেন এই এডস নামক রোগের সচেতনতার বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁচ্ছে দিতে। যার শুরুতে ২০০৪ সালে প্রথমে সে এদেশের ২৮টি রাজ্য সহ পাঁচটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মানুষদের কাছে এই সচেতনতার বার্তা পৌঁচ্ছে দিয়ে দশ মাস পরে বাড়িতে ফেরেন সোমেন। তার পর আবার ২০০৬ সালে সেই সাইকেল কে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে এই সচেতনতার বার্তা পৌঁচ্ছে দিতে আবারও বেরিয়ে পড়েন তিনি।
আর সোমেনের এই বিশ্ব সচেতনতা যাত্রাপথে প্রথমে সে এশিয়ার ২৩ টি দেশে সচেতনতার বার্তা পৌঁচ্ছে দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দেন। সেখানে ৫০ টি দেশে এবং তার পর আফ্রিকার ৫২ টি দেশ সহ মধ্যপ্রাচ্যের ১১টি দেশে এইচআইভি, এডস সচেতনতার বার্তা পৌঁচ্ছে দিতে সক্ষম হন সোমেন। সব মিলিয়ে ইতিমধ্যে ১৮৯টি দেশে এই মারণ রোগের সচেতনতার বার্তা পৌঁচ্ছে দিয়েছেন এই বঙ্গ তনয়। আর এই সচেতনতার বার্তা পৌঁচ্ছে দেওয়ার পাশাপাশি সেই সঙ্গে সোমেন বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন ভারতীয় সাংস্কৃতিকে। যা তার এই সচেতনতা যাত্রাপথ কে করে তুলেছে আরও ভিন্নধর্মী। আর বিশ্বের দরবারে এই সচেতনতার বার্তা পৌঁচ্ছে দিতে গিয়ে সোমেনের কেটে গিয়েছে প্রায় কুড়িটি বছর। যার মধ্যে সোমেন হারিয়েছেন তার বাবাকে। আর সোমেনের এই দীর্ঘ যাত্রাপথে যেমন ৩৮ টি দেশের রাষ্ট্রপতি ৭২ টি দেশের প্রধানমন্ত্রী সহ ১৭৭ টি দেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনার সাথে সাক্ষাৎ করার ভালো স্মৃতি রয়েছে সুন্দরবনের এই যুবকের তেমনি আবার রয়েছে করোনা কালে সেই সময় সব চেয়ে ভয়াবহতার রূপ ধারণ করা দেশ চিনে করোনা আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে আফগানিস্তানে তালিবানদের হাতে আটক হওয়ার মতো হাড়হিম করা ঘটনার গল্পও। আর এই ভালো, খারাপ সহ সমস্ত স্মৃতিকে আগলে রেখে এডস মুক্ত বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে প্রায় দু যুগ ধরে নিজের সাইকেল কে সঙ্গী করে ছুটে চলা সুন্দরবনের এই ক্লান্তহীন বেঙ্গল টাইগার কিন্তূ সব সময় নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। আর এরকম সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১০ই ডিসেম্বর ১৯১টি দেশে এডস সচেতনতা প্রচারের লক্ষ্যমাত্রা সু-সম্পূর্ণ করে দেশের মাটি কলকাতা বিমান বন্দরে পা রাখতে চলেছেন সুন্দরবনের বছর চল্লিশের এই বিস্ময় বালক সোমেন দেবনাথ। তারপর সেখান থেকে তিনি পৌঁছাবেন সোনারপুরের সুভাষগ্রামে। যেখানে সোমেনের রত্না গর্ভা মা ও দুই ভাই থাকেন। আর ১০ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত সুভাষগ্রামে তার মায়ের তৈরী পিপল হাউসে থাকবেন সোমেন। সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা করবেন সোমেন এবং সেই সঙ্গে সেখানেও চলবে এডসের সচেতনতা শিবির।
তারপর ১৭ তারিখ দুপুরে ক্যানিং থেকে বাসন্তীর সোনাখালী স্কুল মাঠ পর্যন্ত প্রায় কুড়ি কিলোমিটার এক সাইকেল র্যালিতে যোগ দেবেন সোমেন। সেখানে সুন্দরবনবাসীদের পক্ষ থেকে আয়োজন করা এক অনুষ্ঠানেও যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে সোমেন দেবনাথের । যেখানে সুন্দরবনবাসীদের পক্ষ থেকে ঘরের ছেলে কে বরণ করে নেওয়ার পরিকল্পনাও চলছে সুন্দরবনবাসীদের মধ্যে। আর ওদিন ঐ অনুষ্ঠান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সোমেন তার ঐ বিশ্ব এডস সচেতনতা যাত্রার সমাপ্তি ঘোষনাও করবেন। এ বিষয়ে উল্লেখ্য যে, ২০০৪ সালের ২৭মে এই বাসন্তী থেকেই সোমেন এই সচেতনতা যাত্রা শুরু করেছিলেন। তবে এখানেই সোমেন থেমে যাবে না! তার মায়ের তৈরি করা সুভাষ গ্রামের ঐ পিপল হাউস থেকে আগামী দিনে চলবে সোমেনের এই সচেতন মূলক কাজ কর্ম। আর সোমেনের ইচ্ছে,আগামী দিনে ঐ গ্রাম কে গ্লোবাল ভিলেজ হিসাবে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের এডস আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর। আর সোমেনের ঘরে ফেরার এই খবরে যেন এখন থেকেই সমগ্র সুন্দরবনবাসী অকাল শারদীয়ার মেতে উঠেছে।কেউ সোমেন কে এক পলক দেখার জন্যে দিন গুনতে শুরু করে দিয়েছেন তো কেউ কেউ আবার সোমেন কে কিভাবে বরণ করবেন সেই চিন্তায় মত্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।