প্রশান্ত সরকার, বাসন্তী : ২৭জুলাই, দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রত্যন্ত ব্লক বাসন্তী—যেখানে নদী, কাদা মাটি আর জঙ্গলের মধ্যে সংগ্রাম করে টিকে আছেন হাজার হাজার মানুষ—সেই জনপদের এক মননশীল দিনে অনুষ্ঠিত হয় এক ব্যতিক্রমী সাহিত্য সম্মেলন ও সুন্দরবন ঐকতান পত্রিকার পঞ্চম সংখ্যা প্রকাশ। এই সম্মেলনের আয়োজন হয় বাসন্তী সাহিত্য পরিষদের সভাপতি প্রভুদান হালদারের নিজ বাড়িতে। উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবনের লেখক, কবি, ও সাহিত্যানুরাগীদের একত্র করে সাহিত্যচেতনার বিস্তার ঘটানো এবং সাহিত্যের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা।
একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে কবি, লেখক, শিক্ষক, উকিল,ইঞ্জিনিয়ার ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা সাহিত্য নিয়ে গভীরভাবে মগ্ন হলেন আলোচনায়, আবৃত্তিতে ও কবিতা পাঠে। এদিনের এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অনাবাসী ভারতীয় আই জি এফ এর সভাপতি শ্রী গনেশ সেনগুপ্ত , জয়গোপাল পুর গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের সম্পাদক শ্রী বিশ্বজিৎ মহাকুড়,শিক্ষারত্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক অমল নায়েক ও সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক শিক্ষারত্ন বিবেক পাল, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনের শিক্ষা ও সমাজসেবায় যুক্ত। ছিলেন বিশিষ্ট কবি হিমাংশু মিস্ত্রী সমাজসেবী সফিক সেখ এবং আরও অনেকে, যাঁরা তাঁদের রচনায় তুলে ধরেন এই জনপদের জীবনের রূঢ় বাস্তব, আশাবাদ এবং স্বপ্ন। এই সাহিত্য সম্মেলনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত ছিল ‘সুন্দরবনের ঐক্যতান’—বাসন্তী সাহিত্য পরিষদের মুখপত্র পত্রিকার ষান্মাসিক সংস্করণের প্রকাশ। পত্রিকায় স্থান পেয়েছে সুন্দরবনের প্রতিভাবান লেখকদের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও শিশু সাহিত্য। সেই সঙ্গে এই অনুষ্ঠানে কবি ও লেখকরা পাঠ করেন তাঁদের স্বরচিত কবিতা—যার প্রতিটি পঙক্তিতে ধরা পড়ে নদীর ঢেউ, বৃষ্টির শব্দ, ঝড়ের আতঙ্ক এবং জীবনের তীব্র টানাপোড়েন। এরপর শুরু হয় গঠনমূলক সাহিত্য আলোচনা, যেখানে তরুণ সাহিত্যপ্রেমী ও শিক্ষকরাও অংশ নেন। আলোচনার মূল বিষয় ছিল—সাহিত্যচর্চা কিভাবে একটি প্রান্তিক জনপদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে পারে। নতুন প্রজন্মকে বই পড়ার অভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করার কৌশল। লোকসাহিত্য সংরক্ষণের প্রক্রিয়া। শিক্ষারত্ন অমল নায়েক বলেন, “সুন্দরবনের ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও মানুষের সংগ্রামের কথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হলে আমাদের সাহিত্যকেই হাতিয়ার করতে হবে। বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ের বাইরেও ভাবতে শিখতে হবে—সেখানে কবিতা, গল্প, লোককথা আমাদের পথ দেখাতে পারে।”
আর এদিনের এই সাহিত্য সম্মেলন সম্পর্কে বাসন্তী সাহিত্য পরিষদের সভাপতি প্রভুদান হালদার বলেন, “এই বাড়িতে বহুবার গানের আসর হয়েছে, কবিতা পাঠ হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। আমি চাই এই বাড়ি শুধু আমার না হোক—এই অঞ্চলের সাহিত্য প্রেমীদের একটা জায়গা হয়ে উঠুক।” তাঁর উদ্যোগে প্রতিবছর সাহিত্য সংক্রান্ত নানা আয়োজন হয়, কিন্তু এই সম্মেলন তাঁর মতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এতে অংশ নেন সুন্দরবনের নানা প্রান্তের তরুণ ও প্রবীণ সাহিত্যিকেরা একসঙ্গে।
বাসন্তীর প্রভুদান হালদারের বাড়িতে আয়োজিত এই সাহিত্য সম্মেলন প্রমাণ করে দেয়—সাহিত্যচর্চার জন্য প্রাসাদ বা মঞ্চের দরকার হয় না, দরকার শুধু একটি উন্মুক্ত মন ও উদ্যোগী হৃদয়। সুন্দরবনের জীবনসংগ্রাম, প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক রসধারাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠছে এক নতুন সাহিত্যধারা, যা হয়তো একদিন পৌঁছে যাবে দেশ-বিদেশের পাঠকের কাছে।