নুরসেলিম লস্কর, কুলতলি : জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ! এ অধ্যায় সুন্দরবনের মানুষের জীবন সংগ্রামের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ! কিন্তূ সুন্দরবনের বাসিন্দাদের এই সংগ্রাম থেকে দীর্ঘমেয়াদী মুক্তির পথে হাঁটতে চলেছে বনদপ্তর ! চলতি শীতের মরসুম থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত অন্তত ৩৮ বার লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে দক্ষিণী রায় অর্থাৎ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। কোথাও ধানখেতে, কোথাও সবজির জমিতে, কোথাও আবার প্রকাশ্যে লোকালয়ে সাধারণ মানুষের চলাচলের রাস্তায়! দক্ষিণী রায়ের রক্ত হিম করা এই অনুপ্রবেশে কার্যত ঘুম উড়েছে কুলতলি, মৈপিঠ, নগেনাবাদ, দেউলবাড়ি, ভুবনেশ্বরী–সহ একাধিক গ্রামের বাসিন্দাদের। একদিকে বাঘ, অন্যদিকে নাইলনের জাল—জীবন যেন প্রতিনিয়ত ‘ঝুঁকির খাঁচায়’ বন্দি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জঙ্গল ঘেঁষা প্রায় ৪৬ কিলোমিটার নাইলনের জাল বসানো হলেও তা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। লবণাক্ত জোয়ারের জল, গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার জলস্রোত আর ঝড়ের দাপটে ওই জাল দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপরন্তু, কাঁকড়া ধরতে যাওয়া মৎস্যজীবীদের নৌকা চলাচলের জন্য বহু জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে জাল কেটে ফেলা হয়—ফেরার পথে তা আর কেউ মেরামত করেন না। এইসব ‘ছিদ্র’ দিয়েই দিব্যি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বাঘ।" আর এই লোকালয়ে ঢুকে পড়া বাঘ গুলিকে বনদফতরের পক্ষ থেকে তিনবার ধরাও হয়েছে খাঁচায়, কিন্তু তাতে আতঙ্ক কমেনি । কারণ এই অনুপ্রবেশ এখন আর ব্যতিক্রম নয়—এ এক নিয়মিত সংকট। আর এই ক্রমবর্ধমান বিপদের মুখে এবার ‘গেম চেঞ্জার’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বনদফতর ও সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ (STR)। নাইলনের বদলে সুন্দরবনের জঙ্গল ঘেঁষা এলাকায় এবার বসানো হবে স্টিলের জাল। প্রাথমিকভাবে ১০০ কিলোমিটার জুড়ে এই স্টিল ফেন্সিং বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে সূত্রের খবর।
বনদফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, "নাইলন নয়, এবার শক্তপোক্ত স্টিলের জাল। কাটা যাবে না, ক্ষয়ে যাবে না, সহজে নষ্টও হবে না। এর ফলে বাঘের অনুপ্রবেশ অনেকটাই রুখে দেওয়া যাবে।" সেই সঙ্গে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে রায়দিঘি রেঞ্জের কুলতলি ব্লককে, কারণ এখানেই বাঘের হানার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাই প্রথম পর্যায়ে এই কুলতলি এলাকার ৪৬ কিলোমিটার জঙ্গল সীমান্তে স্টিল ফেন্সিং বসানোর কাজ শুরু হবে। যার ফলে আর বাঘের সঙ্গে সহাবস্থান নয়, এবার নিরাপত্তার দেওয়াল গড়বে ‘লোহা’ ! এই আশায় বুক বাঁধছে সুন্দরবনের বাসিন্দারা ! আর এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুধু আতঙ্ক নয়, সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জেগে উঠবে স্বস্তির নিঃশ্বাস। মানুষের জীবন ও বন্যপ্রাণ—দু’য়েরই সহাবস্থান নিশ্চিত করতেই এই সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে বনবিভাগ। যা শুধু একটি স্টিলের জাল হিসাবে গণ্য হবে না, যে জাল বদলে দিতে পারে সুন্দরবনের গ্রামীণ জনজীবনের গতিপথ—এটাই এখন আশার আলো।