ঘুটিয়ারী শরীফে গাজী পীরের উরুসে উপচে পড়া ভিড়, মক্কা পুকুরে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা লক্ষাধিক ভক্তের!

ঘুটিয়ারী শরীফে গাজী পীরের উরুসে উপচে পড়া ভিড়, মক্কা পুকুরে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা লক্ষাধিক ভক্তের !


নুরসেলিম লস্কর, ঘুটিয়ারী শরীফ : আজ ঘুটিয়ারী শরীফে গাজী পীর সাহেবের ওরস মেলা উপলক্ষে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বার্ষিক মেলা। সকাল হতেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেন ও ভ্যানগাড়িতে করে ভক্ত, মুরিদ ও সাধারণ মানুষ ভিড় জমিয়েছেন এই পবিত্র ধর্মস্থান ঘিরে। আর মন্দির-মসজিদ-সমন্বিত এই ধর্মীয় স্থানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বহু মানুষ উপস্থিত হন প্রতিবছর গাজী পীরের স্মরণে আয়োজিত এই ওরসে। এবছরও সেই ঐতিহ্যের ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভক্তদের মধ্যে ছিল প্রবল উৎসাহ ও ভক্তিভাব। মেলায় নানান ধরনের দোকানপাট, খাবারের স্টল, ধর্মীয় বইপত্র ও তাবিজ-কবচের দোকানও বসেছে।
     জানা যায়, বাদশাহ চন্দন সাহ’র ছেলে মধ্যযুগের পীর হজরত গাজী সৈয়দ মূবারক আলি শাহ (গাজী সাহেব) ছিলেন দিল্লী নিবাসী। বেলে গ্রামের আদমপুরের জঙ্গলে তাঁর জন্ম। খুব ছোট্টবেলা থেকে তিনি ছিলেন সংসার বিমুখ। তাঁর দুটি পুত্র সন্তান জন্মেছিল—দুঃখী গাজী ও মেহের গাজী। আল্লাহ’র সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় মুবারক সংসার ত্যাগ করেছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে ঘুটিয়ারী শরীফের কাছে বিদ্যাধরী নদীর তীরে নারায়ণপুর গ্রামে আশ্রয় নেন। “তারাহেদে” নামে একটি দিঘীর পাড়ে আস্তানা গাড়েন তিনি। তৎকালীন জমিদার রামচন্দ্র চাটুর্জ্যে তাঁকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। পরে ধোয়াঘাটায় চলে যান। সেখানে হেলা খাঁ নামে অপর এক জমিদারের কাছে আশ্রয় নেন। এরই কাছাকাছি কুলাড়ির সাপুর গ্রামে একটি মরা শেওড়া গাছের তলায় নিয়মিত বসতেন তিনি। বেশ কয়েকদিন পর আশ্চর্যজনকভাবে ঐ মরা শেওড়া গাছ জীবিত হয়। গাছের পাতা, ফল, ফুল ফুটতে থাকে। এমন আশ্চর্য ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন তাঁকে শ্রদ্ধা করতে থাকেন। সেই সময় রাজা মদন রায় এক গুরুতর সমস্যায় পড়েছিলেন। জেল খাটতে হবে নিশ্চিত জেনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি। সে যাত্রায় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মূবারক তাঁকে বাঁচিয়ে ছিলেন। রাজা মদন রায় খুশি হয়ে তাঁকে ঘুটিয়ারী শরীফে ৪৫২ একর (১৩৫৬ বিঘা) জমি পাট্টা দিয়েছিলেন। মূবারকের বড় ছেলে দুঃখী, তাঁর খোঁজ করতে করতে ধোয়াঘাটা এলাকায় গাজী সাহেবের সন্ধান পান। গাজী সাহেবকে কাছে পেয়ে দুঃখী আনন্দিত হয়ে তাঁর সাথেই থাকতে শুরু করেন। সেই সময় ১৭০৭ সালে আবার মহামারী ও মন্বন্তর হয়। সেই সময় অনাবৃষ্টির কারণে চাষ-আবাদ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দুঃখী গ্রামবাসীরা মূবারককে বলেন—“বাবাজী, এখনও বৃষ্টি হল না! চাষ না হলে ছেলেপুলেরা খাবে কী? অনাহারে মারা যাবে।” তিনি ব্যথিত হয়ে ৭ই আষাঢ় ঘুটিয়ারী শরীফে আড়াই কুপ (আড়াই কোদাল) একটি পুকুর খনন করেন। মক্কা শরীফের আল্লাহর কাছে বৃষ্টির আবেদন করার জন্য একটি ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে প্রার্থনায় বসেন। সেই সময় প্রার্থনায় বসার আগেই সতর্ক করে ভক্তদের তিনি বলেছিলেন—“যতদিন পর্যন্ত বৃষ্টি না হবে, ততদিন পর্যন্ত তাঁর ঘরের দরজা যেন কেউ না খোলে।” বিধিবাম, সেই সময় একদল পাঠান তাঁর হাজত নিয়ে প্রার্থনায় মগ্ন ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত ছিলেন পাহারায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মূবারকের কোনো সাড়া না পেয়ে অধৈর্য হয়ে পড়েন তাঁরা। একসময় ঘরের দরজা ভেঙে ফেলেন। দেখা যায়, প্রার্থনায় মগ্ন অবস্থায় মূবারক দেহত্যাগ করেছেন। সেই দিনটি ছিল ঐতিহাসিক ১৭ই শ্রাবণ। আশ্চর্যের বিষয়, তারপর ওই দিনই মেঘভাঙা বৃষ্টি শুরু হয়। সেই থেকে গাজী সাহেবের প্রয়াণের দিনটি বহু বছর ধরে “গাজী সাহেবের উরুস মেলা” নামেই পালিত হয়ে আসছে। ৪৫২ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে গাজী সাহেবের মাজার। ১৭ই শ্রাবণ দিনটিতে ভক্তরা তাঁর আত্মার শান্তির জন্য আয়োজন করেন গাজী বাবার উরুস মেলা। মেলা উপলক্ষে দেশ-বিদেশ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক ভক্ত সমাগম হয়।

এছাড়াও সাধারণ লোকজন মনঃস্কামনা পূরণের জন্য পবিত্রভাবে বাবার নিজ হাতে তৈরি আড়াইকোপ কোদালে কাটা মাজার সংলগ্ন পুকুরে “মক্কা পুকুর”-এ ফুল ভাসিয়ে দেন। কেউ কেউ আবার লাল সুতো কিংবা তালা নিয়ে নিম গাছে বা মাজারে বাঁধেন। যা বহুকাল ধরে আজও সেই রীতি-নিয়ম মেনেই চলে আসছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ঘুটিয়ারী শরীফে ঐতিহাসিক “গাজী সাহেবের উরুস মেলা”। অন্যদিকে অন্যান্য বছরের ন্যায় মেলা শুরুর আগেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমাগম ঘটে। সাধারণ ভক্তদের দাবী—“রাজ্য তথা সারা ভারতবর্ষের এক ঐতিহাসিক মহামানবের মিলনক্ষেত্র গাজী বাবার এই মেলা। ১৭ই শ্রাবণ প্রতি বছরই এখানে এসে গাজী বাবার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন লক্ষ লক্ষ মানুষজন।”

আর এদিনের এই ঐতিহ্যবাহী মেলার নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ঘুটিয়ারী শরীফ মাজারের অন্যতম সদস্য সিরাজ উদ্দিন দেওয়ান জানিয়েছেন,"গাজী বাবার মেলায় কোনো দিনও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তাছাড়াও মেলার নিরাপত্তার জন্য রাজ্য পুলিশ, জিআরপি ও আরপিএফ সহ মোট ১১০০ পুলিশ মোতায়েন থাকছে। পাশাপাশি মাজার সহ আশেপাশে এলাকায় নজরদারির জন্য ৩২টি সিসি ক্যামেরা থাকছে।” 

অন্যদিকে,এক ভক্ত বলেন,"প্রতি বছরই আসি। গাজী পীর সাহেবের কাছে মানত করেছিলাম, সেই মানত পূরণ হতেই এবার পরিবারসহ এসেছি। এখানে এসে মনটা শান্ত হয়ে যায়।” আর গাজী বাবার এই উরুস উপলক্ষে ভিড় সামলাতে শিয়ালদহ-ঘুটিয়ারী শরীফ রুটে বাড়তি ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পূর্বরেল কর্তৃপক্ষ।স্থানীয় প্রশাসনের তরফেও নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উপস্থিত রয়েছেন পুলিশ, সিভিল ডিফেন্স ও স্বেচ্ছাসেবকরা। মেলা প্রাঙ্গণে চলছে নিয়মিত মাইকিং, দেওয়া হচ্ছে পথনির্দেশ ও সতর্ক বার্তাও। আর সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে যে, গাজী পীর শরীফ শুধু একটি ধর্মীয় ভক্তির স্থান নয়—সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবেও পরিচিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন