মানুষের বন্ধু থেকে ‘শত্রু’ হয়ে উঠছে কুকুর ! কেন ? উত্তর খুঁজলেন বিশেষজ্ঞরা ।

মানুষের বন্ধু থেকে ‘শত্রু’ হয়ে উঠছে কুকুর ! কেন ? উত্তর খুঁজলেন বিশেষজ্ঞরা।

নুরসেলিম লস্কর, সুন্দরবন টিভি নিউজ ডেক্স : মানুষের প্রাচীনতম বন্ধু কুকুর। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ও কুকুর পাশাপাশি থেকেছে। শিকার, পাহারা কিংবা সঙ্গ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই কুকুর মানুষের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। অথচ আজকের বাস্তবতা যেন উল্টো চিত্র তুলে ধরছে। দেশের নানা প্রান্তে পথকুকুরদের সংখ্যা বাড়ছে, তাদের আক্রমণে আতঙ্কিত হচ্ছে মানুষ। তাই তো দিল্লিতে একসময় সুপ্রিম কোর্ট পথকুকুরদের রাস্তা থেকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু দেশজুড়ে পশুপ্রেমীদের প্রতিবাদের মুখে সেই নির্দেশে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিল এদেশের শীর্ষ আদালত। আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে— কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? সত্যিই কি কুকুর মানুষের শত্রু হয়ে উঠছে, নাকি মানুষেরই অব্যবস্থাপনা এ সমস্যার জন্ম দিচ্ছে?

  আর এবিষয়ে ইতিহাসের পাতা উলটালে দেখা যায়, প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে নেকড়েরা খাবারের খোঁজে মানুষের কাছে আসতে শুরু করে। প্রথমদিকে পারস্পরিক সন্দেহ থাকলেও ধীরে ধীরে তৈরি হয় আস্থা। মানুষ বুঝতে পারে, নেকড়েদের সঙ্গী করলে শিকার ও নিরাপত্তায় সুবিধা মিলবে। সেই থেকেই শুরু কুকুরের গৃহপালিত যাত্রা। ২০২০ সালে প্রকাশিত Origin and Genetic Legacy of Prehistoric Dogs গবেষণায় দেখা যায়, সব কুকুরের উৎস নেকড়ে। প্রায় ১১ হাজার বছর আগেই কৃষির পূর্বেই কুকুরের পাঁচটি বড় জেনেটিক শাখা তৈরি হয়েছিল। ইতিহাস আরও বলছে, ১২-১৪ হাজার বছর আগে মানুষ তার পরিবারের মতো করেই কুকুরকে সমাধিস্থ করত। অর্থাৎ কুকুর শুধু সহচর নয়, ছিল পরিবারের অংশ। ভারতে যার ঐতিহাসিক প্রমাণও রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা জানাচ্ছেন, মেসোলিথিক যুগ থেকেই এখানে কুকুর ছিল। ভিমবেটকা, আদমগড়, বাগোর, মেহরগড়— বিভিন্ন প্রত্নস্থলে কুকুরের হাড়, ছবি ও মূর্তি মিলেছে। কাশ্মীরের বুরযাহোমে তো মানুষের সঙ্গে কুকুরকে একসঙ্গেই কবর দেওয়া হয়েছে। এসব প্রমাণ থেকেই স্পষ্ট, ভারতীয় সংস্কৃতিতেও কুকুর ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী।

    কিন্তু ইতিহাসের পাতার সঙ্গে আজকের চিত্র ভিন্ন। শহরের রাস্তায় অগণিত পথকুকুর, খোলা ডাস্টবিনে খাবারের খোঁজ, আর মাঝে মাঝেই মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনা। সমাজে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এই কুকুরদের উপস্থিতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যার মূলে রয়েছে মানুষের অব্যবস্থাপনা। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নির্বীজন এবং টিকাকরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা খুবই সীমিত। রাস্তার পাশে খাবার দেওয়া হলেও তাদের স্থায়ী আশ্রয় বা চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া হয় না। ফলে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

আর এ প্রসঙ্গে পশুপ্রেমী সুমন পাঁজা বলেন— “কুকুর কোনোদিন মানুষের শত্রু হতে পারে না। সমস্যা মানুষের তৈরি। আমরা যদি তাদের জন্য সঠিক ব্যবস্থা করি, যেমন— টিকাকরণ, নির্বীজন, খাবার ও নিরাপদ আশ্রয়, তাহলে এরা আবার মানুষের সেরা বন্ধু হিসেবেই প্রমাণিত হবে। কুকুর আমাদের থেকে শুধু ভালোবাসা ও যত্নটাই চায়। তাই ভয় না পেয়ে তাদের দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে।” তাই মানব সমাজকে এই বর্তমান সংকটকাল থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কুকুরকে ‘শত্রু’ নয়, বরং দায়িত্ব হিসেবে দেখতে হবে। নির্বীজন ও টিকাকরণ সঠিকভাবে করা গেলে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে যথাযথ যত্ন নিশ্চিত করা হলে সমস্যা অনেকটাই কমবে। পাশাপাশি পথকুকুরদের প্রতি মানুষের আচরণেও পরিবর্তন আনা জরুরি। শুধু খাবার ছুঁড়ে দেওয়া নয়, তাদের স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার দায়িত্বও নিতে হবে মানুষকে।বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের সহচর থেকে আজ কুকুরকে আতঙ্ক হিসেবে দেখা হচ্ছে। অথচ এ অবস্থার জন্য দায়ী কুকুর নয়, মানুষেরই অবহেলা ও পরিকল্পনার অভাব। তাই কুকুরদের তাড়ানো বা দূরে সরিয়ে দেওয়া নয়, বরং টিকাকরণ, নির্বীজন ও সঠিক যত্নই পারে মানুষ ও কুকুরের সহাবস্থানকে নিরাপদ করতে।" তাই মানুষের এখন উচিৎ হাজার বছরের বন্ধুত্ব যেন অবহেলায় ভেঙে না যায়— সেটাই আজকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন