অন্য আমি

অন্য আমি

রুবি সরকার



বিবেক রায়। 

আদর্শ বিদ্যানিকেতনের শিক্ষক 

সেদিন অটো থেকে নেমে; 

শশব্যস্ত হেঁটে চলেছেন।


হঠাৎ, 

শুনছেন স্যার, শুনছেন 

একটু দাঁড়ান, আপনার ব্যাগটা 

[থামলেন বিবেক বাবু, তাকালেন পিছনের দিকে। 

দেখলেন ছেলেটাকে। শান্ত কন্ঠে বললেন]


'আমাকে কিছু বলছ' 

হ্যাঁ আপনাকে বলছি। 

স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন না,


[ ভ্রু কুঁচকে ভারি চশমাটা বাঁ হাত দিয়ে ঠিক করে]


না; ঠিক চিনতে পারলাম না তো তোমাকে, 

কে তুমি বাবা?


আমি আপনার ছাত্র স্যার 

লাস্ট বেঞ্চে বসা ছাত্র স্বতন্ত্র।


স্বতন্ত্র বোস। 

সেই দুই হাজার ছয় এর ব্যাচ, 

রোজ দেরি করে স্কুলে আসতাম। 

পড়া পারতাম না বলে, 

পেছনের বেঞ্চে বসতাম।

কত শাস্তি দিয়েছেন,

কিন্তু শোধরাতে পারেন নি কিছুতেই। 

আপনার মনে নেই না স্যার?


আমার কিন্তু আজও বেশ মনে আছে; 

ক্লাসের ঘণ্টা পড়লে, 

রোল কলের খাতা, চক্, ডাস্টার আর লাঠি হাতে, 

ধীর পায়ে আপনি আসতেন আমাদের ক্লাসে


মনে পড়ছেনা, না, স্যার।

একাবার আপনি ক্লাসে ঢোকার পর 

পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে- 

ধরা পড়ায় কি মারই না মেরেছিলেন। 

সব কিছু আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। 

আপনার মনে নেই ,না স্যার। 

পয়সাকে টাকা করা, দ্রুত খালি ট্রাঙ্ক ভর্তিকরা, 

শেষে শুরু করে প্রথমে পৌঁছানো 

অংকের এইসব জটিল নিয়ম কত সহজে- 

আপনি বোঝাতেন ক্লাসে। 

মনে পড়ছে না  না, স্যার ,

বিপুল,সৃজন, অবিনাশের কথা ও কি 

আপনার মনে নেই স্যার?


স্কুলের ভালো ছাত্র হওয়ার সুবাদে 

সমস্তপুরস্কার  বাঁধা ছিল ওদের জন্য।

খুব ভালোবাসতেন আপনি ওদের। 

আর, আমি ছিলাম আপনার অবহেলিত 

গাধা পিটিয়ে মানুষ করা ছাত্রের দলে।


[ কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন বিবেক বাবু]


ও হ্যাঁ হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে।

অঙ্কে একবার ১০০ মধ্যে ১০০ পেয়েছিল বলে 

বিপুল কে আমি, 

রামানুজের জীবনী উপহার দিয়েছিলাম।


খুব ভালো ছেলে ছিল বিপুল,

ভীষন ভালোছিল লেখাপড়ায় 

প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি কোনদিন। 

মাধ্যমিকে র‍্যাঙ্ক করেছিল। 

এক নম্বরের বিপুলের কথা বলছতো।

হ্যাঁ, স্যার ওই বিপুলের কথাই বলছি। 

তা কি করছে এখন ওরা সব?


স্যার আপনার আশীর্বাদে, 

বিপুল শুনেছি বেশ নামকরা ডাক্তার। 

নার্সিং হোম করেছে গোটা কয়েক 

কিসব পাচার চক্র-টক্রের সঙ্গে ও নাকি যুক্ত। 

ভাগ্যিস সেদিন পয়সাকে টাকা 

করার নিয়ম শিখেছিল মন দিয়ে।


[ সৃজন আর অবিনাশের খবর কী? 

তারা ও কি দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার জন্যে 

দৌড়াতে  গিয়ে পড়ে যাওয়া বন্ধুকে তোলার কথা ভুলে গিয়েছে। ] 


সৃজনের কথা কী বলব স্যার। 

সততা হার মেনেছে তার সৃজনশীলতার কাছে। 

মস্ত ইঞ্জিনিয়ার, 

বড় বড় বাড়ি তৈরির প্ল্যান দিয়ে টাকা কামাচ্ছে বহুত।


এই তো সেদিন খবরে দেখলাম, 

ওর প্ল্যানে তৈরি নিউটাউনের মস্ত বাড়িটা 

মুহূর্তে  ভেঙ্গে পড়ল তাসের ঘরের মতো। 

আপনি দেখেন নি স্যার।


[ কথাগুলো শুনে কেমন যেন হতবাক হয়ে গেলেন বিবেক বাবু, 

মনে পড়ে গেল রক্তাক্ত স্ত্রীর মুখটা। 

ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমাটা খুলে পরিষ্কার করলেন।]


তা অবিনাশের খবর কী;

 ও কী করছে ?

শুনেছি অবিনাশ জায়গা-জমি সব বিক্রি করে 

কোন নেতাকে টাকা দিয়ে একটা চাকরি কিনেছে।

 কলকাতার নামি স্কুলে এখন পড়ায়।

ভুয়ো মাস্টারদের তালিকায় ওর নাম আছে।


[ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিবেক বাবু]


তা, তুমি এখন কী করছ? 

ক্লাস এইটের পর আর তো স্কুল মুখো হলে না।


আমি? 

আমি আর কি করব স্যার।

এই অটো চালাই।


বইয়ের পড়া বুঝতে কিংবা 

প্রতিযোগিতা মুলক শিক্ষার বাজারে, 

প্রচলিত জ্ঞানের আলোয় অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে, 

আমি তো স্কুলে যাই নি স্যার।


‘মন আর বিবেককে অশিক্ষিত রেখে 

বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে কি লাভ’

আমি  গিয়েছিলাম-

মানবিক মানুষ হতে, 

সত্যের আলোয় সুন্দরের পথে চলতে।

ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে। 

তাই তো আমার আর ওদের মতোন 

নামি দামী মানুষ হওয়া হয়নি স্যার,

কর্তব্যের ভার বইতে গিয়ে-

গাধার মতো পরিশ্রমি থেকে গেলাম।

আপনার টাকার ব্যগটা। 

অটোতে ফেলে এসেছিলেন ধরুন স্যার। 

ভালো থাকবেন। চলি…


দাঁড়াও, শুনে যাও স্বতন্ত্র; 

সবাই যদি তোমার মতো হোতো ,

তাহলে আমাদের সমাজ শিক্ষিত চোর ডাকাত

আর বেয়াদপ প্রজন্মের হাত থেকে বেঁচে যেত। 

তুমি বেঁচে থাকো বাবা। 

ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন