ঝড়খালির শূন্যতা – সোহান-সোহিনীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া এলাকায়।

ঝড়খালির শূন্যতা – সোহান-সোহিনীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া এলাকায়।



প্রশান্ত সরকার , ঝড়খালী
 
সুন্দরবনের এক কোণে, মাতলার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা ঝড়খালি ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্র বহু বছর ধরে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আশ্রয়স্থল। অসুস্থ, দুর্বল বা বিপন্ন বাঘকে এখানে এনে সুরক্ষা দেওয়া হয়, নতুন করে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া হয়। দীর্ঘ কয়েক দশকের ইতিহাসে অসংখ্য বাঘ-বাঘিনীর পদচিহ্নে ভরে উঠেছে এই কেন্দ্র। কিন্তু ২০২৫ সালটি যেন শোকের বছর হয়ে উঠল। মার্চ মাসে মারা গেল বাঘ সোহান, আর সেপ্টেম্বরে শেষ নিশ্বাস ফেলল তার সঙ্গিনী সোহিনী। ফলে একসঙ্গে দু’জন প্রিয় বাসিন্দাকে হারিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে ঝড়খালি।

সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে প্রায় দুই দশক আগে উদ্ধার করা হয়েছিল অসুস্থ বাঘ সোহানকে। বন দপ্তরের পরিচর্যায় সে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং ঝড়খালিতেই কাটিয়ে দেয় দীর্ঘ সময়। শান্ত স্বভাব, রাজকীয় উপস্থিতি আর বিশাল দেহকাঠামো তাকে করে তুলেছিল দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষণ। কর্মীদের কাছেও সে হয়ে উঠেছিল পরিবারের মতো। চলতি বছরের মার্চ মাসে ২১ বছরের বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয় তার। সোহানের মৃত্যুর পর আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে আনা হয় একটি নতুন বাঘিনীকে, যে বর্তমানে সুন্দর ও সোহিনীর সঙ্গী হিসেবে রয়েছে। সোহিনীও ছিলেন ঝড়খালির দীর্ঘদিনের বাসিন্দা। বয়স হয়েছিল প্রায় ২৩ বছর—যা বাঘের গড় আয়ুষ্কালের তুলনায় অনেক বেশি। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সে ঝড়খালির কর্মীদের স্নেহ ও যত্নে বেড়ে ওঠে। দর্শনার্থীদের কাছে সোহান যেমন ছিল আকর্ষণ, তেমনি সোহিনীও ছিল ভরসার প্রতীক। দীর্ঘদিন ধরেই নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিল সে। বন দপ্তরের চিকিৎসকেরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ওষুধের ব্যবস্থা করলেও বুধবার রাতে থেমে যায় তার প্রাণ। বৃহস্পতিবার ময়নাতদন্তের পর দেহ সমাধিস্থ করা হবে বলে জানা গেছে। 

দক্ষিণ ২৪ পরগনা বন বিভাগের ডিএফও নিশা গোস্বামী জানান, “বার্ধক্যজনিত কারণে সোহিনী দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল। চিকিৎসকেরা নিয়মিত পরিচর্যা করলেও শেষমেশ তাকে আর বাঁচানো যায়নি। তার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।” কর্মীদের অনেকে জানান, সোহান ও সোহিনী ছিল যেন পরিবারের সদস্য। প্রতিদিনের খাওয়ানো থেকে শুরু করে চিকিৎসা, খেলাধুলা—সবকিছুতেই ছিল এক আন্তরিক সম্পর্ক। তাদের মৃত্যু কর্মীদের মনে যেন শূন্যতার রেখা এঁকে দিয়েছে। ঝড়খালি ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্র কেবল একটি বাঘ সংরক্ষণাগার নয়—এটি সুন্দরবনের মানুষের কাছে এক গর্বের প্রতীক। এখানে আশ্রয় পেয়ে অসুস্থ বা আহত বহু বাঘ নতুন করে জীবন পেয়েছে। গবেষক ও প্রাণীপ্রেমীদের কাছেও এটি এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কিন্তু সোহান-সোহিনীর মৃত্যু যেন এই কেন্দ্রের ইতিহাসে এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটাল। স্থানীয়রা বলেন, “আমাদের ঝড়খালি মানেই সোহান আর সোহিনী। ওদের ছাড়া জায়গাটা ফাঁকা মনে হবে।” সত্যিই তাই—দুই দশক ধরে এই দুই রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঝড়খালির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। তাদের মৃত্যুতে শূন্যতা তৈরি হলেও স্মৃতি অমলিন হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন। ঝড়খালির এই ক্ষতি কেবল দুটি বাঘের মৃত্যু নয়, এটি সুন্দরবনের মানুষ ও বন দপ্তরের কর্মীদের এক আবেগের ক্ষতি। তবু আশা করা যায়, নতুন প্রজন্মের বাঘ ও বাঘিনী একদিন আবার এই কেন্দ্রকে প্রাণবন্ত করে তুলবে, আর সোহান-সোহিনীর উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাবে আগামীর ঝড়খালি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন