সাতজেলিয়ায় কুমীরের আক্রমণে নিখোঁজ জেলে।

সাতজেলিয়ায় কুমীরের আক্রমণে নিখোঁজ জেলে ।

প্রতিকি ছবি

 মানিক চন্দ্র মণ্ডল  

গোসাবা, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫  : দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের অন্তর্গত গোসাবা ব্লকের সাতজেলিয়া দ্বীপের দত্ত নদীতে বৃহস্পতিবার  দুপুরে ঘটলো এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। স্থানীয় বাসিন্দা সুনীল মণ্ডল (৪৫), নদীর কোমরজলে দাঁড়িয়ে মাছ ধরছিলেন। হঠাৎই এক কুমীর তাঁকে টেনে নিয়ে যায় নদীর গভীরে। বহু চেষ্টার পরও এখনও পর্যন্ত তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি। স্থানীয়দের অনুমান, জোয়ার নামার পর রাতে হয়তো তাঁর দেহ উদ্ধার সম্ভব হবে। ঘটনাস্থলটি দত্ত নদীর একেবারে খেয়াঘাটের কাছে, যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ নৌকায় পারাপার করেন। হাত দশেক দূরে এভাবে কুমীরের হানায় এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। বহু বছর পর লোকালয়ে কুমীরের এমন হামলার ঘটনা যা স্থানীয়দের আতঙ্কিত করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভগবতপুর কুমীর প্রকল্পে আশির দশক থেকে যে প্রজনন কর্মসূচি চালু হয়েছিল, তার ফল এখন প্রকট হয়ে উঠছে। নদী-খাল ভরাট হয়ে আসছে, অন্যদিকে আধুনিক প্ল্যাস্টিক জালের ব্যবহারে মাছের পালাবার পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে নদীতে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্যাভাবে কুমীররা মানুষের দিকে এগোতে বাধ্য হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে কুমীরের গতিবিধি বেড়েছে। কিছুদিন আগে পাথরপ্রতিমা এলাকারয় ও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।   মাস দুয়েক হবে শান্তিগাছী গ্রামেও লোকালয়ে পুকুরে ঢুকে পড়তে দেখা গিয়েছে কুমীরকে । ছোট আকারের কুমীর বলে সাধারণত মানুষের উপর আক্রমণ করে উঠতে পারে নি, তবে যেসব পূর্ণবয়স্ক জায়ান্ট কুমীর নদীতে বিচরণ করছে, তাদের পক্ষে মানুষও শিকার হতে পারে। একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে এরা সহজে পিছু হটে না বলেও বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী। সুনীল মণ্ডলের পরিবারকে ঘিরে এই দুর্ঘটনার বেদনা আরও গভীর। বছর বত্রিশ আগে তাঁর মা বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। সে সময় সুনীল ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই বাবাকেও হারান তিনি। বহু প্রতিকূলতা সয়ে বড় হয়ে ওঠা সুনীল আজ আবার প্রকৃতির আক্রমণের শিকার হলেন। তাঁর স্ত্রী এবং দুই সন্তান রয়েছে। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, সুনীলের মৃত্যুতে পরিবার চরম সংকটে পড়বে। লাশ উদ্ধার না হলে সরকারি ক্ষতিপূরণ পাওয়াটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ঘটনার খবর পেয়ে বনদফতরের কর্মীরা এলাকায় পৌঁছেছেন। তাঁরা সতর্কতা জারি করেছেন নদীতীরবর্তী মানুষদের জন্য। স্থানীয়দের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে মাছ ধরতে বা নদীতে নামতে হলে অত্যন্ত সাবধানে থাকার জন্য। সুন্দরবনের মানুষ বহু বছর ধরে বাঘ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। এখন কুমীরের বাড়তে থাকা আক্রমণ তাঁদের জীবনে নতুন আশঙ্কা যোগ করছে।

আর এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো, প্রকৃতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব সুন্দরবনের জীবনযাত্রায় কতটা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। সুনীল মণ্ডলের পরিবার এখন অপেক্ষা করছে, অন্তত তাঁর মৃতদেহটি যাতে পাওয়া যায়— যাতে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা যায় এবং ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়। কিন্তু এ মুহূর্তে সাতজেলিয়ার দত্ত নদীর তীরে ভর করেছে আতঙ্ক, দুঃখ এবং অনিশ্চয়তা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন