সমলিঙ্গ বিবাহে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন—ভারতের রাজনীতিতে তৈরী হলো এক নতুন অধ্যায়।
প্রশান্ত সরকার , সুন্দরবন টিভি : সুন্দরবনের সবুজ মায়ায় ঘেরা মন্দিরবাজারের এক ছোট্ট মন্দিরে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন দুই তরুণী। সমাজের দীর্ঘদিনের কুসংস্কার, সামাজিক ভীতি ও প্রথার বাঁধন ছিন্ন করে তাঁরা পরস্পরের হাতে হাত রেখে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করলেন। মন্দিরবাজারের ১৯ বছর বয়সি রিয়া সরদার ও বকুলতলার ২০ বছর বয়সি রাখি নস্করের এই সাহসী পদক্ষেপ আজ শুধু ব্যক্তিগত নয়—এ এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মাইলফলক। দুই তরুণীই পেশায় নৃত্যশিল্পী। দুই বছর আগে এক স্থানীয় মন্দিরে তাঁদের পরিচয়। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব রূপ নেয় গভীর ভালোবাসায়। তবে তাঁদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয় সামাজিক চাপ ও পারিবারিক বাধা। রিয়ার পরিবার প্রথম থেকেই এই সম্পর্কে সম্মতি দেয়নি। অথচ রাখির পরিবারের সমর্থনে ও গ্রামের কিছু উদার মানসিকতার মানুষের পাশে নিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, সমাজ যাই বলুক না কেন, তাঁরা একসাথে থাকবেন।
অবশেষে স্থানীয় মন্দিরে সম্পন্ন হয় তাঁদের বিবাহ অনুষ্ঠান। কোনো জাঁকজমক ছিল না, ছিল না বিলাসিতা—ছিল শুধুই আন্তরিকতা, ছিল ভালোবাসার উদযাপন। গ্রামের মানুষজনও যোগ দেন এই আনন্দে। একে অপরকে মালা পরিয়ে জীবনের অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ওঠেন তাঁরা। রাখি বলেন, “আমরা দুই বছর ধরে সম্পর্কের মধ্যে আছি। সারাজীবন একসাথে থাকতে চাই।” আর রিয়ার সোজা উত্তর, “আমি ওকে ভালোবাসি, তাই বিয়ে করেছি। ভালোবাসাই আসল।”
ভারতে যদিও এখনো সমলিঙ্গ বিবাহ আইনি স্বীকৃতি পায়নি, এই বিবাহ তাই ছিল প্রতীকী—কিন্তু তবুও তা ছিল সমাজের প্রতি এক সাহসী বার্তা। এক গ্রামীণ সমাজে, যেখানে এখনও অনেক মানুষ অপ্রচলিত সম্পর্ককে গ্রহণ করতে দ্বিধা বোধ করেন, সেখানে দুই তরুণীর এই পদক্ষেপ সমাজে পরিবর্তনের বীজ বপন করে।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানবিক অবস্থান। ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই বিষয়টি পৌঁছে যায় রাজনৈতিক মহলে। কিন্তু যা সকলকে চমকে দেয়, তা হলো তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকাশ্য সমর্থন। ১০ নভেম্বর স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব নবদম্পতিকে সংবর্ধনা জানায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মথুরাপুরের সাংসদ বাপি হালদার। এই সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ফোনে নবদম্পতির সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁর বক্তব্য মাইকে সম্প্রচারিত হয়।
অভিষেক বলেন, “রিয়া ও রাখি, তোমাদের অভিনন্দন জানাই। তোমরা সমাজের প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে দেখালে—ভালোবাসার কোনো সীমা নেই। জানতাম এটি সহজ নয়, তবুও তোমরা পিছিয়ে যাওনি। তোমাদের সাহস ও ভালোবাসা ইতিহাসে থেকে যাবে। ভালোবাসাই মানবতা, আর মানবতাই সমাজের প্রকৃত মুখ।” তিনি আরও যোগ করেন, “এ শুধু দুই মানুষের বিবাহ নয়—এ বাংলার, এ দেশের গর্ব। তোমরা সমাজের প্রচলিত ধারণা ভেঙে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছ।” এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, এটি ছিল মানবিকতার প্রকাশ। পরে নিজের সামাজিক মাধ্যমে অভিষেক লেখেন, “সামাজিক বেড়াজাল ছিন্ন করে সুন্দরবনের দুই তরুণী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন—এ বাংলার ও দেশের কাছে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁদের সিদ্ধান্ত স্বাধীন ভারতের মুক্ত চিন্তা, মানবিকতা ও সাহসিকতার প্রতীক। তাঁরা সংকীর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক সীমারেখা ভেঙে প্রকৃত ভালোবাসাকে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের সম্পর্ক অমলিন থাকুক।” অভিষেক আরও জানান, তিনি ব্যক্তিগতভাবে সুন্দরবন এলাকায় গিয়ে ওই পরিবারের সঙ্গে দেখা করবেন এবং গ্রামের উন্নয়নের কাজে সহযোগিতা করবেন। তাঁর এই অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়—তৃণমূল কংগ্রেস কেবল রাজনৈতিক সংগঠন নয়, এটি সমাজের প্রগতিশীল ভাবনার বাহক হতে চায়।
ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ঘটনার তাৎপর্য -
ভারতের মূলধারার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই LGBTQIA+ অধিকারের প্রশ্নে নীরব থেকেছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতাকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দিলেও, সমলিঙ্গ বিবাহ এখনো আইনি স্বীকৃতি পায়নি। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানায় যে, সমলিঙ্গ বিবাহ সাংবিধানিক অধিকার নয় এবং স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট এই ধরনের বিবাহে প্রযোজ্য নয়। আদালত সংসদকে আইনগত পথ খুঁজে বের করার পরামর্শ দিলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকাশ্য সমর্থন নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এটি দেখায় যে, প্রাদেশিক রাজনীতি থেকেও পরিবর্তনের বার্তা আসতে পারে। তিনি শুধু সমর্থনই জানাননি, বরং এই সম্পর্ককে “বাংলা ও ভারতের গর্ব” বলে উল্লেখ করেছেন—যা ভারতীয় রাজনীতিতে এক বিরল উদাহরণ।
বাংলার প্রগতিশীল ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা -
বাংলার সমাজবরাবরই চিন্তা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে প্রগতিশীল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়, নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সঙ্গীতে, এমনকি সমকালীন শিল্প ও সাহিত্যে ভালোবাসা ও স্বাধীন চিন্তার প্রতিফলন দেখা গেছে। ভালোবাসা এখানে শুধু সম্পর্ক নয়, এটি প্রতিবাদের এক ভাষাও বটে।রিয়া ও রাখির ভালোবাসা সেই ধারারই অংশ। তাঁদের ভালোবাসা সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন এই প্রতিবাদকে রাজনৈতিক বৈধতা দিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস বরাবরই দাবি করে এসেছে—“বাংলা এগিয়ে চলেছে প্রগতির পথে।” অভিষেকের এই পদক্ষেপ সেই কথাকে আরও শক্ত ভিত্তি দেয়। তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতি শুধু ভোটের হিসাব নয়; রাজনীতি মানবিকতার দিক থেকেও সমাজকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে এক বিপ্লব -
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই বিবাহ কোনও শহুরে অভিজাত পরিসরের নয়—এটি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে সংঘটিত হয়েছে। যেখানে আজও অনেক মানুষ রক্ষণশীল সামাজিক মানসিকতার শিকার, সেখানে গ্রামের মানুষ দুই তরুণীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। রাখির পরিবার এবং কয়েকজন প্রতিবেশীর সহানুভূতিপূর্ণ ভূমিকা প্রমাণ করে, পরিবর্তনের বাতাস নিচুতলার সমাজেও বইছে।অভিষেকের এই সমর্থন তাই কেবল রাজনীতির উচ্চপর্যায়ের পদক্ষেপ নয়, এটি সমাজের নিম্নস্তরে মানবিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার এক প্রয়াসও বটে।
এক প্রজন্মের রাজনীতির প্রতীক -
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এখন তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র হিসেবে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁর নেতৃত্বে দলের ভাবমূর্তিতে ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে নতুনত্ব, সংবেদনশীলতা ও মানবিকতা। রিয়া-রাখির এই ঘটনার প্রতি তাঁর প্রতিক্রিয়া সেই দিকেই ইঙ্গিত দেয়—যে রাজনীতি কেবল প্রতিপক্ষকে আক্রমণ নয়, বরং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক মাধ্যম হতে পারে।তিনি বুঝিয়েছেন, সমাজে গ্রহণযোগ্যতা ও সহমর্মিতা ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বও রাজনৈতিক নেতাদের। তাঁর এই বার্তা স্পষ্ট: ভালোবাসা লজ্জার নয়, ভালোবাসা মানবতার অংশ।
এক নতুন বার্তা ভারতের রাজনীতিতে -
ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা তাই এক “রাজনৈতিক মাইলফলক” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ এটি শুধু দুই তরুণীর সাহসিকতার কাহিনি নয়, এটি একটি মূলধারার রাজনৈতিক দলের সহানুভূতির উদাহরণও বটে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অবস্থান ভবিষ্যতে অন্যান্য নেতাদেরও প্রভাবিত করতে পারে।এই ঘটনাটি আরও এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আনে—সমাজের পরিবর্তন কেবল আইন প্রণয়ন বা আদালতের নির্দেশে নয়, বরং মানুষের মনন ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের মাধ্যমে আসে। রিয়া ও রাখি সেই পরিবর্তনের প্রতীক, আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তার রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা। তাই তো সেদিন সন্ধ্যায় সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ির পাড়ে সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। গ্রাম জুড়ে আলো ছড়াচ্ছিল মন্দিরের প্রদীপ। তখনও রিয়া ও রাখি হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন—মালার ফুল হয়তো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তাঁদের চোখে ছিল ভালোবাসার দীপ্তি। তাঁদের কাছে দিনটি ছিল জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। কিন্তু বাংলার কাছে, এবং সম্ভবত ভারতের কাছেও, এটি এক বৃহত্তর প্রতীক—এক নতুন যুগের সূচনা যেখানে ভালোবাসা আর সাহস একাকার হয়ে যায়। যেখানে একজন নেতার কণ্ঠস্বর সমাজে সহানুভূতির বার্তা ছড়িয়ে দেয়।অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পদক্ষেপ তাই শুধু একটি সমলিঙ্গ বিবাহের প্রতি সমর্থন নয়; এটি এক মানবিক রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত—যেখানে রাজনীতি বিভাজনের নয়, ঐক্যের কথা বলে; ঘৃণার নয়, ভালোবাসার জয়গান গায়। আর সুন্দরবনের সেই মন্দির থেকে উচ্চারিত এই বার্তা আজ গোটা বাংলাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—ভালোবাসাই মানবতার মুখ, আর মানবতাই রাজনীতির শ্রেষ্ঠ রূপ।




