বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঙালি ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রয়াণ দিবসে বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য !

 বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঙালি ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রয়াণ দিবসে বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য !


লেখক : কবি এবং গবেষক সুদীপ চন্দ্র হালদার

‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা সাহিত্যের বাঙালি রচিত প্রথম উপন্যাস। তৎকালীন সময়ে সাহিত্যের বিষয় ছিল সংস্কৃত এবং কিয়দাংশে ইংরেজীর ছায়া মাত্র। ঘি কে ‘আজ্য’, কলা কে ‘রম্ভা’ না বললে-লিখলে আদর্শ সাহিত্যগুন বর্জিত বলে পরিগনিত হতো। আর, মধ্যযুগীয় সাহিত্য ছিল অনেকাংশেই ধর্মীয় চেতনায় সমৃদ্ধ; অল্পকিছু রোমান্টিক, সেখানেও ধর্মীয় চেতনা-নির্ভর কিছু কল্পবিলাসী ভাবনারই পরিস্ফুটন ছিল। ঠিক সেই সময়েই নবনির্মানের চিন্তা নিয়ে, সমাজ জীবনের বাস্তব ভিত্তিক জীবনাচরনের ওপর ভিত্তি করে প্যারীচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর) রচনা করেন ‘আলালের ঘরের দুলাল'(১৮৫৮ সাল); যে সময়ের সাহিত্য ছিল চরনে চরনে ছন্দবদ্ধ কিছু কাহিনী এবং, মজার ব্যাপার এই ধরনের সাহিত্য কর্মের বাংলা পারিভাষিক শব্দ যে ‘উপন্যাস’ সেটাই এক আশ্চর্য বিষয় ছিল। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রেও শুরুতে এই শব্দের প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি, বরং নভেল বলা হয়েছিল! তিনি এই উপন্যাসে কথ্য চলিত ভাষা গদ্য রীতিতে ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে তাঁর এই ভাষা ‘আলালী ভাষা’ বলে প্রচার পায়।


    বাবু রামবাবু টাকার পিছনে নিরন্তর ছুটে চলেছেন, তার বকে যাওয়া ছেলে মতিলাল, স্ত্রৈণতা আর মদ্যপান যার নেশা। বাবার অঢেল টাকায় রাখা দুজন শিক্ষকও ‘নায়ক’ মতিলালের মতিভ্রষ্ট চেতনায় সুমতি আনতে পারেনি। অতঃপর কাহিনীর গতিশীলতায় কাশীতে গিয়ে মতি ফেরে মতিলালের। এই মূল উপজীব্য বিষয় তখনকার বুনিয়াদি পরিবারে প্রায়শই দেখা যেত, প্যারীচাঁদ নিজেই ধনাঢ্য বুনিয়াদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সুস্থিত অদ্রোহী। প্রবাদে বলা হয়েছে উত্তম অধমের সাথে নিশ্চিন্ত চিত্তে চলতে পারেন। প্যারীচাঁদ ‘ইয়াং বেঙ্গল’ এর সদস্যের সাথেও মিশেছেন, ডিরোজিওর ভাবশিষ্য ছিলেন, কিন্তু নিজস্বতা পরিত্যাগ করেননি। নিজেও হতে পারতেন মতিভ্রষ্ট মতিলাল, কিন্তু উল্টো অঙ্কন করেছেন সমাজের মতিলালদের চিত্র।



এই উপন্যাসের পূর্বেই মিসেস ক্যাথরিন মুলেন্স বাংলায় ‘ফুলমনি ও করুনার বিবরন'(১৮৫২ সাল) নামে উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এই উপন্যাসটি ‘The last day of the week’ এর কাহিনীর ছায়া ঘটনা নিয়েই রচিত হয়েছিল। মিসেস মুলেন্স খুব সুন্দরভাবে বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন, কিন্তু কাহিনীর উৎকর্ষতার এটি ছিল নীরস এবং এই সমাজের মানুষের আনন্দ-বেদনার চিত্রবিহীন। আর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর সমসাময়িক সময়ে ভবানীচরনের ‘নব বাবু বিলাস’ রচিত হয়েছিল। সেখানেও বড় লোকের ছেলের বকে যাওয়া কাহিনী চিত্রায়িত হয়েছিল, কিন্তু দর্শক প্রিয়তা পায়নি একতরফা নেতিবাচক দৃশ্যাবলীর কারনে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসে সমাজের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি খুব সুন্দর ভাবে চিত্রায়ণ করেছেন প্যারীচাঁদ মিত্র। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই উপন্যাসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ”উহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট গ্রন্থ তৎপর কেহ প্রনিত করিয়া থাকিতে পারেন অথবা ভবিষ্যত কেহ করিতে পারিবেন কিন্তু ‘আলালের ঘরের দুলাল’ দ্বারা বাংলা সাহিত্যের যে অশেষ কল্যাণ সাধিত হইয়াছে তাহা আর কোন বাংলা গ্রন্থে সেইরুপ হয় নাই।’  



‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর কিছুদিন পরেই রচিত হয় কালী প্রসন্ন সিংয়ের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা'(১৮৬২ সাল)।
যদিও বাংলা সাহিত্যের প্রথম আদর্শ-সার্থক উপন্যাস হিসেবে আমরা ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ কেই জানি, কিন্তু এই উপন্যাসের বীজ রোপিত হয়েছিল ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকেই। আজকের এই দিনেই চিরবিদায় নিয়েছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, বাংলা সাহিত্যের প্রথম দর্শক নন্দিত ঔপন্যাসিক প্যাঁরীচাদ মিত্র। তাই সুন্দরবন টিভির পক্ষ থেকে এই মহান সাহিত্যমানবকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তাঁর সাহিত্য-আলোক আমাদের পথচলায় চিরজাগ্রত থাকুক !


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন